মানবাধিকার সংরক্ষণে ভারতীয় সংবিধান
১) মানবাধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতীয়
সংবিধানে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
অথবা
২) ভারতে মানবাধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক
বিধি-ব্যবস্থাগুলো আলোচনা কর। ১০ (২০২২)
অথবা
৩) ভারতীয় সংবিধানে মানবাধিকার সুনিশ্চিত
ধারাগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে কাকে
নিয়োগ করা যেতে পারে? (২০২৩)
উত্তরঃ
১) মানবাধিকার সংরক্ষণে ভারতের সংবিধানে
গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ আলোচনা করো।
উত্তর;
মানবাধিকার সংরক্ষণে ভারতের সংবিধানে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ;
ভারতীয় সংবিধানকে বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল সংবিধান হিসেবে
বিবেচনা করা হয়, যা মানবাধিকারের
সংরক্ষণ ও সমর্থনের জন্য বিস্তৃত কাঠামো প্রদান করে। মানবাধিকার সংরক্ষণে ভারতের সংবিধানে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ আলোচনা করা হল-
i) সংবিধানের প্রস্তাবনা;
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় "সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক
প্রজাতন্ত্র" হিসাবে ভারতের চরিত্রকে
সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটি "বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য এবং
ভ্রাতৃত্ব" নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে। প্রস্তাবনায় উল্লিখিত এই চারটি মূলনীতি মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে কাজ
করে এবং এগুলি ভারতের জনগণের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সংযুক্ত।
ii) মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার;
ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারগুলিকে
বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রত্যেক
নাগরিকের মানবাধিকারকে সুরক্ষিত করে। এই মৌলিক অধিকারগুলি হল-
ক) সাম্যের অধিকার (আর্টিকেল ১৪-১৮):
খ) স্বাধীনতার অধিকার (আর্টিকেল ১৯-২২):
গ) শোষণের বিরিদ্ধে অধিকার
(আর্টিকেল ২৩-২৪):
ঘ) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (আর্টিকেল ২৫-২৮):
ঙ) শিক্ষা ও সাংস্কৃতি বিষয়ক অধিকার (আর্টিকেল ২৯-৩০):
চ) সংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার
(আর্টিকেল ৩২):
iii) সংবিধানিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা;
মানবাধিকারের সংরক্ষণে সংবিধান বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও
আদালতের ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এবং উচ্চ আদালতগুলি মৌলিক
অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ, আদেশ
বা লেখ জারি করতে পারে। যেমন- বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা,
উৎপ্রেষণ প্রভূতি।
iv) সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহ;
ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশে ৩৬ থেকে ৫১ নং ধারায় "রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি" অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই নীতিমালা রাষ্ট্রকে মানবাধিকারের প্রসারে
সক্রিয় ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেয়। যদিও এগুলি বিচারযোগ্য নয়, তবুও রাষ্ট্রকে এমন আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয় যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার
রক্ষা করে, যেমন: সকলের জন্য যথাযথ জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা, শিশু ও শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রদান, নারী ও শিশুদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রভূতি।
v) জরুরি অবস্থার সময় মানবাধিকার;
জরুরি অবস্থার সময় ভারতের সংবিধানের অধীনে কিছু মৌলিক
অধিকার সীমিত করা যেতে পারে। ধারা ৩৫২, ৩৫৬, এবং ৩৬০ অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তা, যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এর
ফলে ধারা ১৯-এ প্রদত্ত অধিকারগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত হতে পারে।
১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থায় (ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকাল) মৌলিক
অধিকার স্থগিত করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী (১৯৭৮) জরুরি অবস্থার সময় মানবাধিকারের সুরক্ষায় পরিবর্তন আনে। এটি নিশ্চিত
করে যে ধারা ২১ ও ধারা ২২ জরুরি অবস্থার সময়ও অক্ষুণ্ণ থাকবে। এই ব্যবস্থাগুলি
সংকটকালে মানবাধিকার রক্ষায় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
vi) বিচারবিভাগীয় বিভিন্ন রায়;
ভারতের বিচারবিভাগীয় রায়সমূহ মানবাধিকার সুরক্ষায়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানেকা গান্ধী বনাম ভারত সরকার (১৯৭৮) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ধারা ২১-এর "জীবনের
অধিকার" ও "ব্যক্তিগত স্বাধীনতা"কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে
যে এটি শুধু শারীরিক অস্তিত্ব নয়, সম্মানজনক জীবনও অন্তর্ভুক্ত করে। বিশাখা বনাম রাজস্থান সরকার (১৯৯৭) মামলায় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দেশিকা জারি হয়।
এছাড়া শীর্ষ আদালত বনাম গণধোলাই (২০১৮) মামলায় গণপিটুনির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া
হয়। এসব রায় মানবাধিকারকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করার পাশাপাশি সংবিধানের মৌলিক
নীতিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।
vii) সংবিধানের বিভিন্ন ধারা;
ভারতে মানবাধিকার সংরক্ষণে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর্টিকেল ১৪ আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার নিশ্চিত
করে,
যা সকল নাগরিকের সমান আচরণ নিশ্চিত করে। আর্টিকেল ১৯
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরা, এবং সংগঠনের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার প্রদান করে।
আর্টিকেল ২১ জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে রক্ষা করে, যা স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান এবং পরিবেশগত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। আর্টিকেল ২৩ ও ২৪ শোষণের
বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, যেমন জোরপূর্বক
শ্রম এবং শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে। আর্টিকেল ৩২ সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার লঙ্ঘনের
ক্ষেত্রে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার অধিকার দেয়। এছাড়া, আর্টিকেল ২৫-২৮ ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে। এই ধারাগুলো
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সাম্য নিশ্চিত করে মানবাধিকার সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
viii) মানবাধিকার সংগঠন;
ভারতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার লঙ্ঘনের
বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ: জাতীয়
মানবাধিকার কমিশন, রাজ্য ,মানবাধিকার কমিশন। এই কমিশনগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ গ্রহণ করে
এবং তদন্ত করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করে। এক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার সমগ্র দেশে
সক্রিয় থাকে এবং রাজ্য মানবাধিকার
কমিশন প্রতিটি রাজ্যে সক্রিয় থাকে।
ix) মানবাধিকার আইন;
ভারতে মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষা আইন, ১৯৯৩ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনটি আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে, যা ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতা, সমতা, এবং মর্যাদা রক্ষায়
সহায়তা করে। এই আইনের মাধ্যমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। এই আইনে মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তে প্রশাসনের সহযোগিতা
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে মানবাধিকার সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত
করা সহজ হচ্ছে।
x) বিভিন্ন কমিটি ও তার সুপারিশ;
ভারতে মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সুপারিশ প্রদান
করেছে। যেমন- সাচার কমিটি (২০০৬) মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য তথ্য
সংগ্রহ করে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সুপারিশ করে। ভার্মা কমিটি (২০১৩) নারীর
বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে দ্রুত বিচারের জন্য আইনের পরিবর্তন এবং পুলিশ সংস্কারের
প্রস্তাব দেয়। এই কমিটিগুলোর
সুপারিশ বাস্তবায়ন মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং নীতিগত
পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে।
উপসংহার;
ভারতের সংবিধান মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি দৃঢ় কাঠামো প্রদান করে, যা মৌলিক অধিকার, নির্দেশমূলক নীতি, এবং বিচারবিভাগীয় রায়ের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে। এটি শুধু নাগরিকদের অধিকার রক্ষা নয়, দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নেও ভূমিকা রাখে। তবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। উন্নত নীতি ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ভারত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
জাস্ট সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) মানবাধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
২) মানবাধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। ৫ (২০২১)
৪) মানবাধিকারের তৃতীয় প্রজন্মের যে কোনো পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর। ৫ (২০২১)
৫) বিশ্বমানবাধিকারের সনদ (UDHR)-এ লিপিবন্ধ হয়েছে এমন যে-কোনো পাঁচটি মানবাধিকার উল্লেখ কর। ৫ (২০২০)
৬) বিশ্বমানবাধিকারের সনদের (UDHR) নীতিগুলি সংক্ষপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
৮) UDHR-এর উপর সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো। UDHR-এর পূর্ণ রূপটি কী ? ৫ (২০২৩)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
জাস্ট সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) মানবাধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সংবিধানে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) ভারতে মানবাধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক বিধি-ব্যবস্থাগুলো আলোচনা কর। ১০ (২০২২)
৫) নিবর্তনমূলক আটক আইন কী? তুমি কি মনে কর ভারতীয় প্রেক্ষিতে এই আইন মানবাধিকার বিরোধী? ৫ (২০২২)
তৃতীয় অধ্যায়
১) ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠন আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
২) ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) সদস্যদের নিয়োগ আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
৩) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠন বর্ণনা করো। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান সভাপতি কে? ৫ (২০২৩)
৪) ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৫) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ । ৫ (২০২১)
৬) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ । ৫ (২০২২)
৬) ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজগুলি বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২৩)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
জাস্ট সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ । ৫ (২০২০)
২) ভারতে সংগঠিত মানবাধিকার আন্দোলনসমূহের যে কোনো পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর। ৫ (২০২১)
৩) ভারতে মানবাধিকার রূপায়ণের বিভিন্ন সমস্যাগুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
৭) Counter-terrorism-এর উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো। Terrorism-এর সংজ্ঞা দাও। ৫ (২০২৩)
0 মন্তব্যসমূহ