বেন্থামের উপযোগবাদ
ভূমিকাঃ
বেন্থামের
রাষ্ট্রচিন্তার একটি অন্যতম দিক হল উপযোগিতার তত্ত্ব। এই তত্ত্বকেই কেন্দ্র করে বেন্থামের
উপযোগবাদী দর্শন গড়ে উঠেছে। বেন্থাম ইনট্রোডাকশন টু দ্য প্রিন্সিপল্স্ অব্
মরালস্ অ্যান্ড লেজিসলেশন গ্রন্থে তাঁর এই উপযোগবাদী নীতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
করেছেন।
বেন্থামের মতে উপযোগবাদঃ
বেন্থামের মতে উপযোগবাদ হল একটি বস্তুর ধর্ম বিশেষ। যখন
কোনো বস্তু আনন্দ বা সুখ সুনিশ্চিত করতে পারবে তখনই তাঁর বস্তুব উপযোগিতা আছে বলে
মনে করা হয়। অন্যদিকে যখন কোনো বস্তু দুঃখ-কষ্ট বা বেদনা ডেকে আনে,
তখন তাকে উপযোগিতাহীন বলে অবহিত করা হয়। তাই আমাদের সেইসব বিষয় গ্রহণ করা উচিৎ,
যেগুলি
আমাদের সুখ বৃদ্ধি করবে এবং সেইসব বিষয়কে বর্জন করা উচিৎ, যেগুলি
আমাদের জন্য দুঃখদায়ক হবে। বেন্থাম তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ইনট্রোডাকশন টু দ্য
প্রিন্সিপলস অব মরালস্ অ্যান্ড লেজিসলেশন গ্রন্থে বলেছেন যে,
প্রকৃতি
মানুষকে দুটি সার্বভৌম নিয়ন্তার অধীনে রেখেছে। যার একটি হল সুখ এবং অপরটি হল
দুঃখ। মূলত এরাই ঠিক করে দেয় আমাদের কী করা উচিত এবং কি করা উচিৎ নয়।
বেন্থামের উপযোগীতাবাদের বিভিন্ন দিকঃ
বেন্থামের
উপযোগবাদের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত দিক বা
বিষয়গুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-
১) ভোগসুখবাদীঃ
বেন্থামের
উপযোগিতাবাদী তত্ত্বকে ভোগসুখবাদী তত্ত্ব বলে অবহিত করা যেতে পারে। অর্থাৎ এই সুখ
কোনো উচ্চমার্গের নৈতিক আধ্যাত্মিক সুখ নয়,
এহল ব্যাবহারিক জীবনের পার্থিব সুখ। এই সুখকে তিনি মানুষের বস্তুমুখী স্বার্থ ও
সুবিধার সঙ্গে অভিন্ন ক'রে
দেখেছেন। হবসের উপযোগবাদী ধারনাকে সমর্থন করে বেন্থাম বলেছেন যে,
আত্মসুখের
সন্ধানেই মানুষ ছোটে, ব্যক্তিমানুষ অপরের সুখে নয়, নিজের
সুখেই তৃপ্ত হয়। বেন্থাম প্লেটোর ত্যাগবাদ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেননা। প্লেটোর
ত্যাগবাদী নীতিকে বেন্থাম অসাড় বলে
সমালোচনা করেছেন। বেন্থামের মতে, আত্মসুখ
বর্জনের নীতি কখনোই কোনো মানুষের পক্ষে সর্বদা অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
২) পরিমাণগত দিকঃ
বেন্থাম
তাঁর উপযোগিতাবাদে গুণগত দিকের তুলনায় পরিমাণগত দিকের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ
করেছেন। অর্থাৎ সুখ বলতে তিনি সুখের পরিমাণকে না বুঝিয়ে এর পরিমাণগত দিককে তুলে
ধরেছেন। বেন্থামের মতে সুখ বা আনন্দের পরিমাণগত দিক সমান থাকলে,
'পশু-পিন' খেলার
আনন্দের সঙ্গে কবিতাপাঠের আনন্দের কোনো গুণগত পার্থক্য নেই।”
তাই
বেন্থামের উপযোগিতা নীতি সুখের সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃদ্ধির ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব
আরোপ করে।
৩) সুখকলনঃ
বেন্থামের
মতে, অন্যান্য বিষয়ের মত সুখ ও
দুঃখও পরিমাপ করা যায়। এই প্রসঙ্গে তিনি 'সুখকলন'
তত্ত্ব
উপস্থাপন করেছেন। এই তত্ত্বে বেন্থাম গাণিতিক নিয়মে সুখ ও দুঃখের পরিমাপের কথা
বলেছেন। এজন্য কতগুলো বিষয়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যেমন- সুখের তীব্রতা কতখানি,
স্থায়িত্ব
কতখানি ও নিশ্চয়তা কতখানি। তাছাড়াও দেখতে হবে সুখ আমাদের হাতের কাছে আছে না দূরে
আছে ইত্যাদি। সুখকলন তত্ত্বের মাধ্যমে সুখ ও দুঃখের পরিমাণের মধ্যে তুলনা আমাদের
পরিমাপ করে দেখতে হবে কোনটার পরিমান অধিক হয়। এক্ষেত্রে সুখের পরিমাণ অধিক হলে মানুষের
কাজ বা আচরণ ভালো ও নীতিসম্মত বলে বিবেচিত হবে অন্যদিকে দুঃখের পরিমান অধিক হলে
মানুষের কাজ বা আচরণ অনৈতিক বা মন্দ বলে প্রতিপন্ন হবে।
৪) সমাজের হিতসাধনঃ
বেন্থামের
উপযোগিতাবাদ নীতি
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থক। এখানে ব্যক্তির স্বার্থের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব
আরোপ করা হয়। তবে ব্যক্তিজীবনে ক্রিয়াশীল এই স্বার্থের বিষয়টিকে সমাজ জীবনেও
প্রয়োগ করা যেতে পারে। বেন্থামের মতে, ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে
কোনো পার্থক্য নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যেই বেন্থাম সমাজের হিতসাধনের নীতি
উপস্থাপন করেছেন। সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখলাভ যেমন ব্যক্তির চুড়ান্ত লক্ষ্য,
তেমনি
সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ হিতসাধনই হল সমাজের চুড়ান্ত লক্ষ্য।
৫) ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়ঃ
ব্যক্তিস্বার্থের
সঙ্গে সামাজিক স্বার্থের বিরোধের বিষয়ে বেন্থাম সতর্ক ছিলেন। তাই বেন্থাম ব্যক্তিস্বার্থ
এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনের কথা বলেছেন। বেন্থামের মতে,
মানুষের
মধ্যে যেমন আত্মসুখ অর্জনের প্রবণতা থাকে ঠিক তেমনি পরার্থ-সুখ লাভেরও প্রবণতা দেখা
যায়। আর এভাবেই ব্যক্তিস্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধন ঘটানো সম্ভব হয়।
সমালোচনাঃ
বেন্থামের
উপযোগবাদ নীতি দিক দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপুর্ণ কিছু সমালোচনা
নীচে আলোচনা করা হল-
১) স্থূল বৈষয়িক জীবনদর্শনঃ
আদর্শবাদীরা
বেন্থামের হিতবাদী তত্ত্বকে একটি অতি স্থূল বৈষয়িক জীবনদর্শন বলে পরিহার করেছেন। তাদের
মতে, তখনই মনুষ্যত্বের সার্থক বিকাশ ঘটে, যখন
মানুষ তার কাজকর্ম ও আচরণের উৎস বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের নৈতিক মূল্যায়ন করে এবং
এর প্রেক্ষিতে সৎ ও ভালো লক্ষ্যকে বেছে নেয়। কিন্তু বেন্থামের তত্ত্বে কাজের উৎস
বিচারের প্রয়োজনীয়তাকে মেনে নেওয়া হয়নি। তাঁর মতে, অন্তিম
ফল বা পরিণতিই হল একমাত্র বিচার্য বিষয়। চরম সুখই হল মানুষের পরম নৈতিক আদর্শ।
২) নৈতিক ধারনাকে অস্বীকারঃ
বেন্থামের
উপযোগবাদ প্রাকৃতিক অধিকার, সার্বভৌমিকতা
এবং অন্যান্য অধিবিদ্যক চরম ধারণার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক মূল্যায়নের বিষয়টিকেও
পরিহার করেছে। বেন্থাম যুক্তি ও বিচারবিবেচনাকে কোনরকম গুরুত্ব দেননি। কিন্তু আমরা স্বভাবত যা
করি এবং যুক্তি ও বিচারবিবেচনা প্রয়োগ ক'রে
যা করা উচিত বলে মনে করি—এই দুইয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু
বেন্থাম এই পার্থক্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না। তাঁর মতে, সুখের
সন্ধান করাই হল মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। আবার, তিনি
সুখ অর্জনের চেষ্টা করাকেই মানুষের কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছেন।
৩) ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনে ব্যর্থতাঃ
বেন্থামের
উপযোগিতা নীতির আর একটি অন্যতম দুর্বলতা হল, তিনি ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক
স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। বেন্থামের মতে,
মানুষের
মধ্যে যেমন আত্মসুখ অর্জনের প্রবণতা থাকে ঠিক তেমনি পরার্থ-সুখ লাভেরও প্রবণতা দেখা
যায়। আর এভাবেই ব্যক্তিস্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধন ঘটানো সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবে এই
ধরনের সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়নি। বেন্থাম মানুষের আচার-আচরণের যে লক্ষ্যের কথা
বলেছেন, তা মানুষের নৈতিকতা
নয়, তা হল এক ধরনের স্থূল
সুবিধাবাদ। এরূপ সুবিধাবাদ কখনোই সামাজিক স্বার্থের ভিত্তি হতে পারেনা।
৪) অসম্পুর্ণ ধারনাঃ
বেন্থামের
উপযোগবাদী ধারনাটি বিশেষভাবে অসম্পুর্ণ। বেন্থাম মানুষের মনস্তত্ত্বের যে-ছবিটি
এঁকেছেন, তা যথেষ্ট নয়।
ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের গভীরে প্রবেশ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সুখ
ও দুঃখ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল ভাসাভাসা। এর ফলে আমরা উপযোগিতা সম্পর্কে ভুল
সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বেন্থামের উপযোগবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। বেন্থাম উপযোগিতার সূত্র দিয়ে মানুষের আচরণের যে-বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবানুগ ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন, তার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস
(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
৩) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৪) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২২)
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
0 মন্তব্যসমূহ