উপযোগবাদ; utilitarianism

Ad Code

উপযোগবাদ; utilitarianism

 হিতবাদ বা উপযোগবাদ


ভূমিকাঃ

শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাব থেকে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচিন্তা মুক্ত হতে পারেনি। এর ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত যে-মতবাদ ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচিন্তায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা হল হিতবাদ বা উপযোগবাদ। এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তারা হলেন, হিউম , হেলভেটিয়াস , প্রিস্টলি, বেক্কারিয়া প্রমুখ। 

সংজ্ঞাঃ

হিতবাদের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কারণ, বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্নভাবে হিতবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও হিতবাদের ধারনার মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। হিতবাদের মূল কথা হলসর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সংখ্যক সুখ লাভ'। হিতবাদীদের মতে, দুই সার্বভৌম নিয়ন্তার অধীনে প্রকৃতি মানুষকে রেখেছে। এই দুই নিয়ন্তা হল—সুখ ও দুঃখ। সব মানুষই সুখ বা আনন্দ চায় এবং দুঃখ বা কষ্টকে পরিহার করতে চায়। সুখের পিপাসা আর দুঃখ থেকে পরিত্রাণের আকুতি—এই দুইয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানুষের যাবতীয় চিন্তা, আচরণ ও কর্ম। বেত্থাম হিতবাদকে একটি বস্তুর ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একটি বস্তুর উপযোগিতা আছে বলে তখনই মনে করা হবে, যদি সেই বস্তু আনন্দ বা সুখ সুনিশ্চিত করতে পারে। অপরদিকে, যে-বস্তু দুঃখকষ্ট বা বেদনা ডেকে আনে, তাকে উপযোগিতাহীন বলে গণ্য করা হবে। হ্যালোওয়েল এর মতে, হিতবাদ হল বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি ক'রে নৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব গঠনের এক প্রচেষ্টা। 

প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

হিতবাদের উপরিউক্ত সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-

১) বাস্তবতার ওপর গুরুত্ব আরোপঃ

হিতবাদ আদর্শের চেয়ে বাস্তবতাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রধানত দুটি বাস্তব  উপাদানের ফল হিসাবে হিতবাদের বিকাশ ঘটেছিল। এই উপাদানদুটি হল-

ক) ফরাসি বিপ্লবঃ

ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা হিতবাদ সরাসরি প্রভাবিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের বিমূর্ত স্বাভাবিক অধিকারের ধারনা হিতবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে।  এই বিপ্লবের মাধ্যমেই হিতবাদীরা হিতবাদের আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল।

খ) অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভবঃ

অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভব হিতবাদের উত্থানে সরাসরি সাহায্য করেছিল। অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাবে যুক্তিবাদের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে। অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে উপযোগিতার তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে উপযোগিতাই হল সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি। 

২) নীতি নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপঃ

হিতবাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল নীতি নৈতিকতা। হিতবাদ অনুযায়ী কোনো কাজের নৈতিক মূল্য নির্ধারিত হয় আনন্দ বর্ধনের ক্ষেত্রে তার উপযোগিতার দ্বারা, তার অর্ন্তনিহিত গুণাবলির দ্বারা নয়। উপযোগিতার মাপকাঠিতে সমাজের যাবতীয় বিষয়কে বিচার করতে হবে। উপযোগিতা পর্যাপ্ত না হলে মানুষ তা বর্জন করতে পারে।

৩) আইন সংক্রান্ত ধারনার ওপর গুরুত্ব আরোপঃ

নীতি নৈতিকতার পাশাপাশি হিতবাদ আইন-সংক্রান্ত ধারনার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছে। হিতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় আইনের লক্ষ্য হল সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ হিত বা কল্যান সাধন করা এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় আইন প্রনীত হওয়া উচিৎ।  

৪) ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ওপর গুরুত্ব আরোপঃ

হিতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারনা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। হিতবাদীরা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সুখের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা সমাজকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র্য কোনো সমাজব্যবস্থায় তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেননা। তাঁদের চোখে সমাজ হল ব্যক্তির সমষ্টিমাত্র। সমাজের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি সমান মর্যাদার অধিকারী।

৫) উদারনীতিবাদী ধারণার ওপর গুরুত্ব আরোপঃ

হিতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারনা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিতবাদ রাষ্ট্র-সংক্রান্ত বিষয়ে উদারনীতিবাদী ধারণা গ্রহণ করেছে। হিতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র  মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে ওঠা স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র হল মানুষের দাবি পূরণ ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিষ্ঠান মাত্র। রাষ্ট্রের কাজ হল নাগরিকদের শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রদানে এবং তাদের ইচ্ছাপূরণে সহায়তা করা।

সমালোচনাঃ

হিতবাদ বিভিন্ন দিক থেকে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগুলি নীচে আলোচনা করা হল-

১) অতিসরলীকরণ ধারনাঃ

হিতবাদ অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। মানবিক উদ্দেশ্যের বিশ্লেষণ এবং তাকে সুখ ও দুঃখ বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা বাস্তবসম্মত নয়। সব মানুষ সুখ বা আনন্দ চায় এবং দুঃখ বা কষ্টকে পরিহার করতে চায় এমন ধারনা সঠিক নয়।  অনেক সময় মানুষ আদর্শ বা নীতির জন্য লড়াই করে এবং তা করতে গিয়ে সে অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করে থাকে। সুতরাং মানুষ দুঃখ-কষ্টকে পরিহার করতে চায়—এ কথা সর্বাংশে সত্য নয় ।

২) বুর্জোয়া শ্রেণির মানসিকতার প্রতিফলনঃ

অমল কুমার মুখোপাধ্যায়ের হিতবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, হিতবাদের মধ্যে সমকালীন বুর্জোয়াশ্রেণির মানসিকতা ও প্রয়োজন প্রতিফলিত হয়েছে।" লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশই ছিল হিতবাদের মূল উপাদান। উচ্চতর জীবনাদর্শ ছিল অপ্রাসঙ্গিক। হিতবাদীরা যে-মানুষের ছবি এঁকেছেন, তা হল এক বুর্জোয়া মানুষ। সে শুধু নিজের স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়।

৩) বৈষয়িক সুখঃ

হিতবাদীরা যে-সুখের বর্ণনা দিয়েছেন, তা ছিল মূলত ব্যক্তিস্বার্থভিত্তিক বৈষয়িক সুখ। কাজেই সর্বাধিক পরিমাণ সুখের ধারণার দ্বারা পরোক্ষভাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ সম্পদ আহরণের কথাই বলা হয়েছে।

৪) সমাজ ও ব্যাক্তির সমন্বয় সাধনে ব্যার্থতাঃ

সমগ্র সমাজ ও ব্যক্তির সন্তুষ্টির মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সম্ভব, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হিতবাদে পাওয়া যায় না। সুখ প্রকৃতিগত দিক থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক; তা কখনোই সর্বজনীন হতে পারে না।

৫) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপঃ

হিতবাদের অন্যতম ত্রুটি হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভলির ওপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ। রাষ্ট্রের সুসমন্বিত সম্পর্ককে এই তত্ত্বে অস্বীকার করা হয়েছে। হিতবাদীরা মনে করতেন যে, সমাজ হল এর সদস্যদের আঙ্কিক যোগফল মাত্র। ব্যক্তির জীবন ও উদ্দেশ্য ছাড়া সমাজের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই।

মূল্যায়নঃ

উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে উপযোগবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না।  নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব হিসেবে হিতবাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেলেও রাজনীতি ও আইনব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সংস্কারের ক্ষেত্রে হিতবাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ

এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস


(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


Main Menu

Main Menu


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code