রুশোর সাধারন ইচ্ছা
ভূমিকাঃ
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জাঁ জ্যাক রুশো অষ্টদশ শতাব্দীতে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর লেখা দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল- আ ডিসকোর্স অন দ্য মর্যাল এফেক্টস অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস আ ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অব্ ইনইকুয়ালিটি। তাঁর সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে সাধারণের ইচ্ছা সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা ছিল অন্যতম।
রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছাঃ
রুশোর সামাজিক চুক্তিতত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘সাধারণ ইচ্ছা। রুশোর মতে, সামাজিক
চুক্তির মাধ্যমে যে মিলিত শক্তি গড়ে উঠেছিল, তাই হল সাধারণ
ইচ্ছা। ওই চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যেকে সকলের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেও কেউই বিশেষ
কোনো একজনের অধীনস্থ হল না। কারণ, প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ
চুক্তি সম্পাদন ক'রে সার্বভৌম 'সাধারণ
ইচ্ছা'র হাতে তাদের সমস্ত প্রাকৃতিক অধিকার এবং ক্ষমতা
স্বেচ্ছায় অর্পণ করেছিল। এরূপ ইচ্ছা হল তাদের সকলের শুভ ইচ্ছার সমষ্টি।
রূশোর সাধারণ ইচ্ছার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
উপরিউক্ত সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুশোর সাধারণ ইচ্ছার নিম্নলিখিত
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-
i) সাধারণ ইচ্ছা অভ্রান্তঃ
রুশোর মতে, সাধারণ
ইচ্ছা অভ্রান্ত এবং সে হিসেবে তা সকল অধিকারের যথার্থ মানদন্ড হিসেবে কাজ করে।
সাধারণ ইচ্ছার লক্ষ্য হলো সকলের কল্যাণ সাধন করা। কাজেই সাধারণ ইচ্ছা সর্বদাই
অভ্রান্ত ও সঠিক।
ii) সার্বভৌমঃ
রুশোর মতে, সাধারণ
ইচ্ছা চমর ও চুড়ান্ত এর ওপর আর কোনো ইচ্ছা থাকতে পারেনা। তাই সাধারণ ইচ্ছা
সার্বভৌম। জনগণের মধ্যে চুক্তির ফলে এই সার্বভৌম সাধারন ইচ্ছার সৃষ্টি হয়েছে।
iii) অবিভাজ্যঃ
রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা অবিভাজ্য। কারন এটাকে বিভাজ্য করলে সামগ্রিক কল্যাণের পরিবর্তে আংশিক কল্যাণ অর্থাৎ কেবল ব্যাক্তি কল্যান সাধিত হবে।
iv) ঐক্যের প্রতীকঃ
রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছা
রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক। সাধারণ ইচ্ছাকে টিকিয়ে রাখতে হলে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের
সংহতি বজায় রাখতে হবে।
v) গণ মুক্তির সহায়কঃ
সাধারণ ইচ্ছা গণ মুক্তির
সহায়ক। সকলে সাধারণ ইচ্ছার নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। কেউ এর বিরুদ্ধচারণ করলে সামাজিক
চুক্তি অনুযায়ী বল প্রয়োগের দ্বারা তাকে তা মানতে বাধ্য করা হয়।
vi) সবার ইচ্ছার প্রতিফলনঃ
সাধারণ ইচ্ছা সকল অবস্থাতে
চূড়ান্ত, ন্যায্য ও সঠিক।
সাধারণ ইচ্ছায় কোন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন প্রাধান্য থাকেনা, কিন্তু সবার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।
viii) সকল ক্ষমতার উৎসঃ
সাধারণ ইচ্ছা সকল ক্ষমতার উৎস। সরকার হচ্ছে এখানে সাধারণ ইচ্ছার ভৃত্য। ইহা সাধারণ ইচ্ছার মতানুযায়ী কার্যকর থাকে।
সমালোচনাঃ
রুশোর সাধারণ ইচ্ছার মতবাদ
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এর সমালোচনাও কোনো
অংশে কম নেই। নীচে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-
i) অস্পষ্ট ধারনাঃ
রুশোর সাধারণ
ইচ্ছা তত্ত্বের মধ্যে ধারনাগত অস্পষ্টতা বা পরস্পর বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। রুশো
সাধারণ ইচ্ছাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তিনি কখনো সাধারণ ইচ্ছাকে সকলের ইচ্ছা থেকে পৃথক করার কথা বলেছেন, আবার কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকেই সাধারণ ইচ্ছা বলে উল্লেখ করেছেন।
ii) অসম্পুর্ণ ধারণাঃ
রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের মধ্যে
ধারনাগত অসম্পুর্ণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ
ইচ্ছাকে কীভাবে গড়ে তোলা যাবে, সে সম্পর্কে রুশো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি।
অনেকের মতে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি বিমূর্ত ধারণার
ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে এর প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে।
iii) মাপকাঠির অনুপস্থিতিঃ
রুশো সাধারণ ইচ্ছা ও সকলের
ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করলেও বাস্তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা
অসম্ভব। কারন এই পার্থক্য নির্ধারণের কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই বললেই চলে।
iv) বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্নঃ
রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের অন্যতম সমস্যা হল তার বাস্তব প্রয়োগ।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছাড়া সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটা অসম্ভব। কারন
রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছার কোনো প্রতিনিধি
থাকতে পারে না।কিন্তু বর্তমান বিশ্বে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র যথেষ্ঠ বিরল।
v) গোষ্ঠি বা সংগঠনের অস্তিত্ব অস্বীকারঃ
গোষ্ঠী, দল প্রভৃতির অস্তিত্ব ও কার্যকলাপ সম্পর্কে রুশো সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, এগুলি সাধারণ ইচ্ছার প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয়। কিন্তু আজকের দিনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংগঠনের মূল্য অপরিসীম। সংগঠিত গোষ্ঠীসমূহের ইচ্ছা রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতাকে দমিয়ে রাখতে পারে।
vi) সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারঃ
কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা রুশোর উদ্দেশ্য হলেও
তাঁর 'সাধারণ
ইচ্ছা' সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারিতায় রূপান্তরিত হয়েছে।
মানুষের যে-সম্মতি নিয়ে সাধারণ ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত সেই ইচ্ছাই যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের
ইচ্ছা অনুযায়ী চলে, তখন ব্যক্তির সম্মতির আর কোনো গুরুত্ব
থাকেনা। রুশো বলেছেন যে, কোনো ব্যক্তি যদি সাধারণ ইচ্ছার
নির্দেশ মানতে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে তা মানতে বাধ্য করা
হবে, যা কখনোই সমর্থন করা যায়না।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রুশোর সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারন রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের চেষ্ঠা করা হয়েছে। তার সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই আধুনিক গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস
(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
৩) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৪) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২২)
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
0 মন্তব্যসমূহ