রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব rawls theory of justice

Ad Code

রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব rawls theory of justice

রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব


ন্যায়ের সংজ্ঞাঃ

সাধারণভাবে ন্যায় বলতে ন্যায্যতা, বিশুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতাকে বোঝায়। যা কিছু সত্য, নির্ভুল ও যুক্তিসংগত তা হল ন্যায় এবং যা এর বিপরীত তা হল অন্যায়। এক কথায় ন্যায় হল চরম সত্য, আদর্শবোধ, পরিপূর্ণতা ও বিশুদ্ধতার প্রতীক। সুতরাং ন্যায় হল মূলত একটি নৈতিক ধারণা।

একটি নৈতিক ধারণা হিসেবে ন্যায়ের ধারণাটি গতিশীল। অতীতে যাকে ন্যায় বলে মনে করা হত, পরবর্তীকালে তা ন্যায়নীতি বিরোধী বলে প্রতিপন্ন হতে দেখা যায়। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রজীবনে প্রতিটি শ্রেণি যখন নিজ নিজ শ্রেণিগত কার্মে নিযুক্ত থাকে, এবং কখনোই অন্য শ্রেণির কাজে হস্তক্ষেপ করেনা, তখন তাকে ন্যায় বলে।

রলসের মতে ন্যায়বিচার:

        জন রলস্ তাঁর A Theory of Justice  গ্রন্থে ন্যায়বিচার সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা ও সুযোগ, আয় ও সম্পদ, আত্মমর্যাদা প্রভৃতি হল যে-কোনো সমাজের প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রী। এই সমস্ত দ্রব্যসামগ্রীর ন্যায্য বন্টন ব্যবস্থাই হল ন্যায়। এগুলির অসম বণ্টনও ন্যায়নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, যদি তার দ্বারা সমাজে সবচেয়ে কম সুবিধার মধ্যে থাকা মানুষদের উপকার হয়।

এখন প্রশ্ন হল, সমাজের প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রী কীভাবে বন্টিত হলে সকলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে। সমাজের প্রত্যেক মানুষই চায় অন্যের থেকে বেশি পেতে। স্বাভাবিকভাবেই বণ্টনকে কেন্দ্র করে মানুষে-মানুষে বিরোধ বাধতে পারে। আবার বন্টিত প্রাথমিক বিষয়গুলির মধ্যেও বিরোধ বাধতে পারে। এটাই হল ন্যায়ের সমস্যা।

উপরিউক্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে জন রলস্ পরামর্শ প্রদান করেছেন। রলস্ সমাধান সূত্র হিসাবে ন্যায়ের দুটি নীতি এবং অগ্রাধিকারের দুটি নিয়ম নির্ধারণ করেছেন-

ন্যায় সম্পর্কিত রলস-এর  প্রথম নীতিঃ

জন রলসের ন্যায় সম্পর্কিত প্রথম নীতিটি হল সকলের জন্য সমান মৌল স্বাধীনতা সম্পর্কিত। রলসের মতানুসারে প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বাধিক প্রসারিত মৌল স্বাধীনতার ব্যাপারে সমানাধিকার থাকবে। মৌল স্বাধীনতার ব্যাপারে ব্যক্তি মানুষের এই অধিকার অন্যান্য সকলের অনুরূপ স্বাধীনতার অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া দরকার। জন রলসের মতানুসারে ন্যায়কে বুঝতে হবে ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতার দিক থেকে; এবং ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতাকে বুঝতে হবে সাধারণের বা সকলের কল্যাণের দিক থেকে।

ন্যায় সম্পর্কিত রলস-এর দ্বিতীয় নীতিঃ

ন্যায় সংক্রান্ত রলসের দ্বিতীয় নীতি হল সকলের জন্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ন্যায্য সাম্য সম্পর্কিত। এই দ্বিতীয় নীতিটির দুটি অংশ বর্তমান। প্রথম অংশটি 'বিভেদ নীতি' হিসাবে পরিচিতি। রলসের মতানুসারে সামাজিক ও আর্থনীতিক বৈষম্যসমূহকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা দরকার যাতে তারা যুক্তিসঙ্গতভাবে সকলের সুবিধায় আছে, এবং বিশেষত সমাজের সর্বাধিক অনগ্রসর ব্যক্তিবর্গের সুবিধায় আসে। ন্যায়ের এই দ্বিতীয় নীতিটিকে ‘সর্বাধিক নীতি'ও বলা হয়।

ন্যায় সম্পর্কিত রলসের দ্বিতীয় নীতির বক্তব্য অনুযায়ী সামাজিক ও আর্থনীতিক বৈষম্যসমূহকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে, সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য সাম্যের অবস্থায়, তারা সকলের জন্য উন্মুক্ত বিভিন্ন পদ ও অবস্থানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। অভিন্ন সামর্থ্য ও দক্ষতাযুক্ত ব্যক্তিবর্গের জীবনের সুযোগ-সুবিধা অভিন্ন হওয়া দরকার। ব্যক্তি মানুষ কি রকম আয়সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, তা বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত নয়।

ন্যায় সম্পর্কিত রলস-এর প্রথম অগ্রাধিকারের বিধানঃ

জন রলসের সাম্য সম্পর্কিত উপরিউক্ত দুটি নীতির সঙ্গে অগ্রাধিকারের দুটি বিধান সংযুক্ত। জন রলসের অভিমত অনুযায়ী ন্যায়ের ধারণার প্রথম নীতিটি দ্বিতীয় নীতিটির তুলনায় অগ্রাধিকার লাভ করবে। অর্থাৎ স্বাধীনতার অধিকারের ধারণাটি সামাজিক ও আর্থনীতিক সম্পদের বণ্টনের থেকে অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য।

ন্যায় সম্পর্কিত রলস-এর  দ্বিতীয় অগ্রাধিকারের বিধানঃ

দ্বিতীয় অগ্রাধিকারের বিধান সর্বাধিক করণের নীতির জন্য দক্ষ বণ্টনের থেকে সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য সাম্যের উপর অগ্রাধিকার আরোপ করে। অর্থাৎ সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য সাম্যের নীতি অগ্রাধিকার পাবে দক্ষ বণ্টন ও কল্যাণের নীতি এবং সুযোগ সুবিধার সর্বাধিকীকরণের উর্ধ্বে।

সমালোচনাঃ

জন রলসের ন্যায় সম্পর্কিত মতবাদ বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা রলসের ন্যায় তত্ত্বের নিম্নলিখিত সমালোচনাগুলি উল্লেখ করেছে। যেমন-

১) পুঁজিবাদের সমর্থকঃ

সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী রলস্ তাঁর মতবাদের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে সমর্থন করেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে রলস্ এক নূতন তাত্ত্বিক যুক্তির অবতারণা করেছেন।

২) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারনার প্রাধান্যঃ

ন্যায় সম্পর্কিত রলসের মতবাদ বহুলাংশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারনার দ্বারা প্রভাবিত। রলসের মতবাদ অনুযায়ী ব্যক্তি মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাবশেই যাবতীয় কষ্ট সহ্য করে। এই বক্তব্য সর্বাংশে সত্য নয়।

৩) স্ববিরোধীতাঃ

ন্যায় সম্পর্কিত রলসের প্রথম নীতি ও দ্বিতীয় নীতির মধ্যে বিরোধ বর্তমান। প্রথম নীতিতে সমানাধিকার এবং সকলের জন্য অধিকারের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় নীতিতে অসাম্যকে সমর্থন করা হয়েছে।

৪) বৈষম্যমূলক ধারণাঃ

রলস্ অসাম্যমূলক ব্যবস্থার মধ্যেই সকলের জন্য স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কিন্তু এই বক্তব্য বিভ্রান্তি জনক। অসম অবস্থায় অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বাধীনতা হল অধিকতর বলবানদের স্বাধীনতা। এ‌ হল দুর্বলকে দাবিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালীদের স্বাধীনতা।

৫) স্বাধীনতার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপঃ

রলস্ তাঁর মতবাদে স্বাধীনতার নীতিকেই অধিকতর সমর্থন করেছেন। সাম্য সম্পর্কেও রলসের উচ্চাশাযুক্ত বক্তব্য আছে, এ কথা ঠিক, কিন্তু স্বাধীনতার প্রতি তাঁর অধিক আগ্রহ অপ্রকাশিত থাকেনি।

মূল্যায়নঃ

        রলসের ন্যায় তত্ত্বের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হলেও এর গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। জন রলসের ন্যায় সম্পর্কিত মতবাদ হল সময়োপযোগী একটি মতবাদ। বিংশ শতাব্দীর একটি পর্যায়ে উদারনীতিবাদ বিবিধ বিরূপ সমালোচনার কোপে পড়ে এবং হীনবল হয়ে যায়। এইরকম এক প্রেক্ষাপটে বিরুদ্ধবাদীদের সমকালীন বিবিধ প্রশ্নের সম্যক সমাধান পাওয়া গেছে রলসের মতবাদে।

 

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রথম অধ্যায়

১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)


৪) রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)


৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)


৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।


৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)


৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)


১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। একত্ববাদী তত্ত্বের মূখ্য প্রবক্তা কারা? ১০ (২০১৯), ১০ (২০২২)


৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)

তৃতীয় অধ্যায়

১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।


২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)


৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

চতুর্থ অধ্যায়

১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।


২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


৩)  নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)


৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)

পঞ্চম অধ্যায়

১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)


২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)


৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)


৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)


৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

Main Menu



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code