প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব
ভূমিকাঃ
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গ্রিক
রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে তৃতীয় শতকে তার
রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর লেখা তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল
রিপাবলিক, স্টেটম্যান এবং লজ। প্লেটোর সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হল তার ন্যায়বিচারের ধারণা।
ন্যায় সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্বঃ
প্লেটো
তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্ব উপস্থাপন করার আগে ন্যায়বিচার সম্পর্কে কতকগুলি
আদর্শস্থানীয় মতামতকে উপস্থাপিত করেন এবং এইসব মতামতের আলোকে তিনি তাঁর নিজের
অভিমত ব্যক্ত করেন। এই মতামতগুলি হল-
i) সনাতন তত্ত্বঃ
এই
তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন সেফেলাস ও পলিমার্কাস। সেফেলাসের মতে,
কথায়
ও কাজে সত্যনিষ্ঠ হওয়া এবং ঈশ্বর ও মানুষের যেটুকু প্রাপ্য সেটুকু দিয়ে দেওয়াই হল
ন্যায়। সেফেলাসের পুত্র পলিমার্কাস এর মতে, প্রত্যেক মানুষকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়াই হল
ন্যায়। তিনি আরও বলেন, 'বন্ধুর
ভালো করা এবং শত্রুর ক্ষতিসাধন করাই মধ্যেই
ন্যায় নিহিত আছে।
প্লেটো
এই তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেন, একটি ডাকাত বা একজন বিকৃত মস্তিষ্ক মানুষের হাত
থেকে যে মারণাস্ত্রটি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটা
তার প্রাপ্য বলে পুনরায় তাকেই সেটা ফিরিয়ে দেওয়া কোনোমতেই যুক্তিযুক্ত নয়।
তাছাড়া কে বন্ধু কে শত্রু তার বিচার করবে কে? সর্বোপরি,
কোনো
মানুষের ক্ষতিসাধন করা যথার্থ ন্যায়ধর্ম নয়।
ii) আমূল সংস্কারবাদী তত্ত্বঃ
এই
তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন থ্রেসিমেকাস। থ্রেসিমেকাসের মতে, জোর যার মুলক তার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন
রাষ্ট্র যা নির্ধারন করবে সেটাই ন্যায়।
এরূপ
চিন্তার বিরুদ্ধে প্লেটোর বক্তব্য হল, ন্যায়পরায়ণ
এবং প্রাজ্ঞ না হয়ে বাহুবলে শক্তিমান বা ক্ষমতার অধিকারী হলে সে কেবল নিজের সুখ ও
নিজের স্বার্থ দেখবে, যা
শেষ পর্যন্ত অরাজকতা ডেকে আনবে।
iii) বাস্তবধর্মী তত্ত্বঃ
এই
তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন গ্লুকোঁ। গ্লুকোঁর মতে, ন্যায়নীতি বা নৈতিকতা হল সুযোগ
সুবিধার ব্যাপার অর্থাৎ আমরা কিছু পাই বলেই ন্যায়নীতির আশ্রয় নিই। কিছু না পেলে
ন্যায়নীতি বিসর্জন দিতে আমরা কুণ্ঠিত হইনা।
গ্লুকোঁ
এরূপ চিন্তার বিরুদ্ধে প্লেটোর বক্তব্য হল, গ্লুকোঁ তার ন্যায় তত্ত্বকে ভ্রান্ত
ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে ন্যায়কে একটি বাহ্যিক বিষয় হিসাবে দেখানো
হয়েছে।
প্লেটোর মতে ন্যায়ঃ
ন্যায়
সম্পর্কিত উপরোক্ত বক্তব্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পর প্লেটো তাঁর নিজের ন্যায়
বিচারের ধারণা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে প্লেটো মানুষকে তিনটি ভাগে ভাগ
করেছেন। প্লেটোর মতে প্রতিটি ব্যক্তির
মধ্যে তিন ধরনের উপাদান রয়েছে। যেমন-
ক)
প্রজ্ঞা (wisdom),
খ)
সাহস (courage), ও
গ)
প্রবৃত্তি (appetite)।
ব্যক্তি
জীবনের এই তিন ধরনের অবস্থার সমন্বয় বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্নভাবে ঘটে
থাকে। যেমন, কারও মধ্যে প্রজ্ঞার
মাত্রা অধিক, আবার কারও মধ্যে
প্রবৃত্তির মাত্রা অধিক। আবার কারও মধ্যে সাহসের মাত্রা বেশী। এমতাবস্থায়
ব্যক্তির জীবনের তিনটি অবস্থার হেরফের রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনটি শ্রেণী তৈরী করে।
যেমন-
ক)
প্রজ্ঞা বিশিষ্টরা দার্শনিক শ্রেণীভুক্ত ।
খ)
সাহসীরা যোদ্ধা শ্রেণী ও
গ)
প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিতরা কৃষক বা উৎপাদক শ্রেণীভুক্ত।
ব্যক্তি
জীবনে যখন বিক্রম ও প্রবৃত্তি প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়,
তখন
ঐ ব্যক্তির জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরা হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনের
বেলাতেও অনুরূপভাবে দার্শনিক, যোদ্ধা
ও উৎপাদক শ্রেণী যখন নিজ নিজ যোগ্যতা, প্রকৃতি
ও প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কাজকর্ম করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
সুতরাং
প্লেটোর মতে ন্যায়বিচার হলো কর্মবিশেষীকরণের মাধ্যমে কর্মবন্টন করা ও যোগ্যতা
অনুযায়ী কাজ করা এবং এ ভাবে পারস্পরিক সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা।
ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্যঃ
প্লেটোর
ন্যায়বিচারের তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়।
যথা-
i) বদ্ধ সমাজঃ
প্লেটোর
ন্যায়বিচার তত্ত্বে সব নাগরিকের স্থান পূর্বনির্ধারিত। প্লেটো একটি বিশেষ পেশাগত
প্রকোষ্ঠে সব নাগরিকদের আবদ্ধ রেখেছেন যা প্রত্যেক মানুষের জন্য সমাজে তার
নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেয়।
ii) ব্যাক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থীঃ
প্লেটোর
ন্যায়তত্ত্বে ব্যাক্তি স্বাধীনতার পরিবর্তে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্লেটোর মতে, সর্বোৎকৃষ্ট
রাষ্ট্রের পক্ষে যা কল্যাণজনক, তাই
হল "ন্যায়'।
iii) শ্রেণী বৈষম্যঃ
প্লেটো
তার ন্যায় তত্ত্বে মানুষের গুণগত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন সেখানে
সংখ্যাগরিষ্ঠ উৎপাদক শ্রেণীকে সবার নীচে স্থান দিয়েছে।
iv) প্রবর শাসনঃ
প্লেটো
তাঁর ন্যায়তত্ত্বের সাহায্যে রাষ্ট্রের গুণাগুণকে সম্পূর্ণভাবে শাসকশ্রেণির
চরিত্রগত গুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল করে তুলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উপেক্ষা
করেছেন।
v) নৈতিক মূল্যের প্রাধান্যঃ
প্লেটো
তার ন্যায় তত্ত্বে নৈতিক মূল্যের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর
রাষ্ট্রতত্ত্ব নীতিশাস্ত্রের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি।
সমালোচনাঃ
প্লেটোর ন্যায় তত্ত্ব সমালোচনার উর্দ্ধে
নয়। সমালোচকরা প্লেটোর ন্যায় তত্ত্বের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত সমালোচনাগুলি উল্লেখ
করেছেন। যেমন-
i) বদ্ধ সমাজঃ
প্লেটোর
ন্যায়বিচার তত্ত্বে সব নাগরিকের স্থান পূর্বনির্ধারিত। তাই একটি বিশেষ পেশাগত
প্রকোষ্ঠে নাগরিকদের আবদ্ধ রেখে তিনি কার্যত ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকারকে অস্বীকার করেছেন।
ii) ব্যাক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থীঃ
প্লেটোর
ন্যায়তত্ত্বে ব্যাক্তি স্বাধীনতার পরিবর্তে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মতে রাষ্ট্রের
পক্ষে যা কল্যাণজনক, তাই
হল "ন্যায়'।
এর অর্থ—আদর্শ রাষ্ট্রবিরোধী যে-কোনো কাজই অন্যায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে
প্লেটো আদৌ মর্যাদা দেননি।
iii) শ্রেণী বৈষম্যঃ
প্লেটোর
ন্যায়তত্ত্ব একদিকে যেমন ব্যাক্তিকে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করেছে অন্যদিকে তেমনি
সংখ্যা গরিষ্ঠ উৎপাদক শ্রেণীকে সংখ্যালঘিষ্ঠ শাসক শ্রেণীর অধীনে স্থাপন করে কার্যত
শ্রেণিবৈষম্যকেই শাশ্বত বলে প্রচার করেছে।
iv) প্রবর শাসনঃ
প্লেটোর
তাঁর ন্যায়তত্ত্বের সাহায্যে রাষ্ট্রের গুণাগুণকে সম্পূর্ণভাবে শাসকশ্রেণির
চরিত্রগত গুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল করে তুলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উপেক্ষা
করেছেন এবং এক ধরনের 'প্রবর শাসন'
প্রতিষ্ঠার
সপক্ষে নানা ধরনের অবাস্তব তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
v) নৈতিক মূল্যের প্রাধান্যঃ
প্লেটো
নৈতিক মূল্যের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব
নীতিশাস্ত্রের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। নৈতিক মূল্যের দোহাই দিয়ে তিনি এক
অনৈতিক ও অন্যায় সমাজব্যবস্থাকেই সমর্থন করেছেন।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও প্লেটোর ন্যায় তত্ত্বের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। প্লেটো তাঁর ন্যায় তত্ত্বে প্রতিটি শ্রেণীর নিজ নিজ কাজকর্ম সম্পাদনের যে কথা বলেছেন তা বর্তমান সময়েও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস
(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
৩) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৪) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২২)
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
0 মন্তব্যসমূহ