লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ; locke's social contract theory

Ad Code

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ; locke's social contract theory

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ


ভূমিকাঃ

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জন লক সপ্তদশ শতাব্দী থেকে অষ্টদশ শতাব্দীতে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর লেখা দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল অন লিবার্টি  এবং টু ট্রিটিজেস অফ গভর্নমেন্ট। তাঁর সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে অন্যতম হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ।

লকের মতে সামাজিক চুক্তিঃ

লকের মতে প্রকৃতির রাজ্যে সাম্য, স্বাধীনতা ও শান্তি বিরাজ করত। প্রকৃতির আইনের অধীনে মানুষ সুখে শান্তিতে বাস করত। কিন্তু সেখানে বিদ্যমান ছিল কতিপয় সমস্যা। এই সমস্যাসমূহ দূর করার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সর্বসম্মতিক্রমে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাই হল লকের সামাজিক চুক্তি।

প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

লকের সামাজিক চুক্তি মতাবাদের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত প্রকৃতি বৈশিষ্ট্যগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। যথা- 

১) রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের ভিত্তিঃ

হসের মতোই লক্ও সামাজিক চুক্তি মতবাদকে রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃতির রাজ্যের কতকগুলি অসুবিধা দূর করার জন্য সেখানকার মানুষেরা অবাধ সম্মতির ভিত্তিতে একটি সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রসমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিল। চুক্তির মাধ্যমে যে-রাষ্ট্রসমাজ প্রতিষ্ঠিত হল, তার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। হসের মতে, সামাজিক চুক্তি থেকে উদ্ভব ঘটেছিল একক সার্বভৌম শক্তির। কিন্তু লক্ মনে করতেন যে, সামাজিক চুক্তির ফলে সমগ্র রাষ্ট্রসমাজ যৌথভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। 

২) সকলের সম্মতিই চুক্তির ভিত্তিঃ

লকের মতে, সকলের সম্মতিই ছিল চুক্তির ভিত্তি। তিনি বলেছেন যে, মানুষ প্রকৃতিকগত দিক থেকে স্বাধীন ও সমান হওয়ায় কেবল নিজের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের প্রতি কখনোই আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারে না। রাষ্ট্রসমাজের কার্য পরিচালনার জন্য লক্ সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন। সংখ্যালঘু জনগণ অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে। কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মেনে চলতে বাধ্য। লক্ মনে করতেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনই হল সামাজিক চুক্তি থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রসমাজকে অটুট রাখার একমাত্র উপায়। জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি আনুগত্য না দেখালে রাষ্ট্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ কাঠামো ভেঙে পড়বে। সুতরাং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পুরসমাজের প্রশাসন চলবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী। 

৩) ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষাঃ

সার্বভৌম রাষ্ট্রসমাজের অন্যতম কর্তব্য হল ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষা করা। এই তিনটি অধিকার হল অহস্তান্তরযোগ্য। নিজের ইচ্ছানুযায়ী প্রাকৃতিক আইন প্রণয়ন, প্রণীত আইন ব্যাখ্যার ও কার্যকর করার অধিকারই শুধু ব্যক্তি অর্পণ করেছিল। 

৪) সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাঃ

চুক্তির ফলে আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। এরূপ ক্ষমতা কখনোই যথেচ্ছ হতে পারে না। জনস্বার্থ রক্ষা করাই ছিল এই ক্ষমতার চরম লক্ষ্য। রাষ্ট্রসমাজের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কখনোই অসীম ও অবাধ হতে পারে না। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রশক্তির প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য তার স্বেচ্ছাদত্ত সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁর মতে, যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয় কিংবা যখন জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়, তখন জনসাধারণ তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অধিকার সংগতভাবেই প্রয়োগ করতে পারে। 

৫) দ্বিতীয় চুক্তিঃ

লক্ সুস্পষ্টভাবে কোথাও দুটি চুক্তি সম্পাদনের কথা না বললেও তাঁর দ্বিতীয় ট্রিটিজ গ্রন্থটির বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, আদিম মানুষ সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমাজ গঠনের পর অছি বা জিম্মাদার (trustee) হিসেবে সরকার গঠন করেছে। স্যামুয়েল ভন পুফেনডর্ফ (Samuel Von Pufendorf) অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দুটি চুক্তির কথা বলেছেন। একটি হল ব্যক্তিমানুষদের নিজেদের মধ্যে, যার ফলে লোকসমাজ (Community) গড়ে ওঠে এবং অপরটি হল লোকসমাজ ও সরকারের মধ্যে। 


সমালোচনাঃ

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগুলি নীচে আলোচনা করা হল-

১) সংখ্যালঘুর স্বার্থ উপেক্ষিতঃ

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদে সংখ্যালঘুর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে।  লকের মতে, সামাজিক চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে মেনে চলতে বাধ্য করা। কিন্তু লক্ এ কথা ভাবেননি যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনও স্বৈরাচারী হতে পারে। সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে ও সংখ্যালঘিষ্ঠের সমস্যা সম্পর্কে তিনি কোনো আলোচনা করেননি। কোনো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে একমত হতে না পারলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে — এরূপ বক্তব্যে মেনে নেওয়া যায়না। 

২) ধারনাগত বিভ্রান্তিঃ

    লক্ কোথাও দ্বিতীয় চুক্তির কথা বলেননি। কিন্তু তাঁর গ্রন্থের একাধিক স্থানে তিনিমূল চুক্তি' কথাটি ব্যবহার করেছেন। এর দ্বারা বোঝায় যে, অন্য একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছিল। সুতরাং দ্বিতীয় চুক্তি যে এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুনেডর্ফ এবং আলসিয়াস ( Althusius) যেমন স্পষ্ট করে দুটি চুক্তির কথা বলেছেন, লক্‌ তা বলেননি। লক্‌ স্পষ্ট করে এ কথাও বলেননি যে, মূল চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র অথবা সরকার কিংবা উভয়েই গঠিত হয়েছিল।

৩) প্রকৃতির রাজ্য-সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে অ-সংগতিপূর্ণঃ

লকের চুক্তি তত্ত্ব তাঁর প্রকৃতির রাজ্য-সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষেরা চুক্তি করে রাষ্ট্রসমাজ গঠন করেছিল। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যের যে-চিত্র তিনি অঙ্কন করেছেন, তা রাষ্ট্র-সমাজের থেকেও ভালো ছিল। জনগণ চুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির রাজ্য ত্যাগ করলেও তারা প্রাকৃতিক আইনকে বর্জন করতে পারেনি। বরং, প্রাকৃতিক আইন চুক্তির একটি অংশে পরিণত হয়েছে। বস্তুত, চুক্তিতত্ত্বকে লক্ পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থেই ব্যবহার করেছেন। সম্পত্তির অধিকারকে অক্ষত রাখার জন্যই মানুষ চুক্তি করেছিল।

৪) আইনগত সার্বভৌমিকতা উপেক্ষিতঃ

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদে আইনগত সার্বভৌমিকতার ধারনা উপেক্ষিত হয়েছে। লক যতখানি রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, আইনগত সার্বভৌমিকতা বিষয়ে ততখানি আগ্রহী ছিলেন না। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য আইনগত সার্বভৌমিকতা অতি আবশ্যক।

৫) বার্কার এর সমালোচনাঃ

    বার্কার-এর মতে, লক কেবল সামাজিক চুক্তির উল্লেখ করেছেন,যা কোনো সরকারি চুক্তির বিষয় নয়। তা ছাড়া তিনি স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করলেও সমতার বিচারে যুক্তিনিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারেননি।

মূল্যায়নঃ

    লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হলেও এর গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না।   কারন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনভিত্তিক আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। আবার, সরকারি ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি উদারনীতিবাদের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।

 

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস


(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


Main Menu



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code