মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
ভূমিকাঃ
মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বলাবাহুল্য, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসবাদের প্রধান ভিত্তি বা ইমারত। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সাহায্যে মার্কস ও এঙ্গেলস মানব সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন।
মার্কসের মতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদঃ
সাধারনভাবে মার্কস-এর দার্শনিক ও রাজনৈতিক
চিন্তার সামগ্রিক রূপটিকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলা হয়। স্তালিন বলেছেন, দ্বন্দ্বমূলক
বস্তুবাদ হল 'মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির বিশ্ব বীক্ষা'
। একে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
বলা হয় এই কারণে যে, ঘটনাবলির প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি, ওই
ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের পদ্ধতি হল দ্বন্দ্বমূলক।
উদ্ভব ও বিকাশঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বা ইংরেজি
প্রতিশব্দ "Dialectical Materialism'
এর Dialectical শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Dialego
থেকে,
যার
অর্থ হল আলোচনা বা তর্ক করা। প্রতিপক্ষের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধগুলিকে
প্রকাশ করে প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়ার পদ্ধতিকেই অতীতে 'ডায়ালেকটিকস্'
বলা
হত। প্রাচীন এই পদ্ধতিকে আধুনিককালে যিনি প্রথম ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেন তিনি হলেন
জার্মান দার্শনিক হেগেল। কিন্তু
হেগেল দ্বান্দ্বিক বিকাশের পদ্ধতিকে প্রয়োগ করেছেন শুধুমাত্র ভাব বা চেতনার জগতে। কিন্তু মার্কস তা প্রয়োগ করেছেন
বস্তু জগতের ক্ষেত্রে। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ কার্ল মার্কস স্বীকার করে নিলেও সমাজ
পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মার্কস হেগেল কে অনুসরণ করেননি।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল, এই বস্তুজগৎ হল গতিশীল এবং সদা পরিবর্তনশীল। প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত স্ব-বিরোধ বর্তমান। প্রকৃতির এই অন্তর্নিহিত স্ববিরোধের ফলে বস্তুজগতের পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ বস্তুজগতের এই পরিবর্তন ও বিকাশ হল পরস্পর-বিরোধী প্রাকৃতিক শক্তির ঘাত-প্রতিঘাতের পরিণতি। মার্কসের মতানুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল এই বাহ্যিক জগৎ ও মানুষের চিন্তার গতি সম্পর্কিত সাধারণ বিধির বিজ্ঞান। দ্বন্দ্ববাদের বিধান হল বিশ্বজনীন। এই বিধান সমাজ ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। আবার এই বিধান মানুষের চিত্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা
বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায়।
যেমন-
i) পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনঃ
বস্তুজগতের পরিবর্তন বা
বিকাশের ধারা সরল পথে চলে না। বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন ধীর গতিতে চলতে চলতে হঠাৎ
গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়। এই পরিবর্তন এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে
উল্লম্ফনের আকারে প্রকাশিত হয়। যেমন- জলকে
উত্তপ্ত করলে প্রথমে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছোয় তখন জল ফুটতে
থাকে এবং বাষ্পে পরিণত হয়। জল থেকে জলীয় বাষ্পে রূপান্তর হল তাপের পরিমাণগত
পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন।
ii) বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামঃ
দ্বন্দ্ববাদের দ্বিতীয়
সূত্র অনুসারে, প্রতিটি বস্তুর মধ্যে পরস্পর বিরোধী প্রবণতা বা বৈপরীত্য থাকে। এই
পরস্পরবিরোধী প্রবণতার সংঘাত বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। সমাজব্যবস্থার মধ্যেও
অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব থাকে। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক
ব্যবস্থায় সামস্তপ্রভু ও ভূমিদাসদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ছিল, এই দ্বন্দ্বের ফলে
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ও ধনতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
iii) নেতির নেতিকরণঃ
দ্বন্দ্ববাদের তৃতীয় সূত্র অনুসারে, বিকাশের
অপরিহার্য উপাদান হল অস্বীকৃতি বা নেতি। এর অর্থ হল-কোনো বস্তু থেকে উদ্ভূত বস্তু
পূর্বেকার বৈশিষ্ট্যগুলিকে অস্বীকৃতি জানায়। অর্থাৎ, পুরাতন
থেকে নতুনের জন্ম হয়, কিন্তু একসময় এই নতুনের মধ্যেও
অস্বীকৃতি দেখা যায়। একে নেতির নেতিকরন বলে। উদাহরণ হিসাবে দাস সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার
করে সামন্ত সমাজ,
সামন্ত
সমাজকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদী সমাজ,
আবার
পুঁজিবাদী সমাজকে অস্বীকার করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের কথা বলা যায়।
iv) সকল বস্তু পরস্পর নির্ভরশীলঃ
বস্তুজগতের সকল ঘটনা ও বিষয়
পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বস্তুজগতের সকল বস্তু ও ঘটনার মধ্যে প্রকৃতিগত
পারস্পরিক সংযোগ বর্তমান। পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোন বিষয়ের বিশ্লেষণ
করা যায় না তাই এই বস্তুজগৎ হল সামগ্রিক বিচারে সুসংহত ও অখণ্ড প্রকৃতির।
v) বস্তুমাত্রেই গতিশীলঃ
এই বিশ্ব প্রকৃতির কোন কিছুই শাশ্বত বা চিরন্তন নয় এবং অনড় বা অচল নয়। বস্তুমাত্রেই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। নতুন বস্তুর জন্ম এবং পুরাতনের ধ্বংস প্রাকৃতিক জগতে সতত ঘটে চলেছে। বস্তুর উদ্ভব ও বিকাশের বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই গতিশীলতা বা পরিবর্তনশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়।
সমালোচনাঃ
মার্কসের
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও এর সমালোচনাও কোনো অংশে
কম নয়। নীচে মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-
i)জটিল মানবসমাজঃ
দ্বান্দ্বমূলক
বস্তুবাদকে জটিল মানবসমাজের ক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ করা অসম্ভব। কারণ,
বস্তুজগতের
বিকাশের নিয়ম এবং মানবিক সম্পর্ক ও মানবসমাজের বিকাশের নিয়ম অভিন্ন নয়। এছাড়া মানবসমাজে বিভিন্ন ধরনের বহু
জটিল সমস্যা বর্তমান। বস্তুজগতের নিয়মাবলীর সাহায্যে এই সমস্ত সমস্যাদির যথাযথ
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না।
ii) সর্বহারার চেতনার প্রধান্যঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে এই
জগৎ, জীবন ও
মানুষের অবস্থানকে পর্যালোচনা করা হয়েছে সর্বহারার চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজ
বিকাশে সর্বহারা শ্রেণীর বাইরে অন্যান্য শ্রেণীরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে
মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে তার উল্লেখ নেই।
iii) স্বাধীনতার ভূল ব্যাখ্যাঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে
সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজাতির স্বাধীনতার রাজ্যে উত্তরণের কথা বলা
হয়েছে। মানুষের স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই ব্যাখ্যা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। কারন
সাম্যবাদী সমাজের বাইরেও ব্যাক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে।
iv) লক্ষ্য সংক্রান্ত ভুল ব্যখ্যাঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বস্তু অপেক্ষা
বস্তুর গতিকে অধিক গুরুত্ব দিলেও গভির শেষ কোথায়, তা
ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন। তা ছাড়া,
গতির
লক্ষ্য সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্য যে যথার্থ ও চুড়ান্ত,
এ
কথা প্রমান করা সম্ভব হয়নি।
v) নতুনত্বের অভাবঃ
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পশ্চিমি
সমালোচকরা মনে করেন যে, দ্বন্দ্বতত্ত্বের
আলোচনায় মার্কস-এঙ্গেলস কোনোরকম নতুনত্ব দাবি করতে পারেন না। কারণ,
এঁদের
বহু পূর্বেই বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারন মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গভীর তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস
(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
৩) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৪) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২২)
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
0 মন্তব্যসমূহ