হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ; hobbes' social contract theory

Ad Code

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ; hobbes' social contract theory

 হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ


ভূমিকাঃ

হবসের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ। এই মতবাদের সাহায্যে হবস রাষ্ট্রের উৎপত্তির ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন।  হবস তাঁর 'লেভিয়াথান সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ  করেছেন।


সামাজিক চুক্তির কারনঃ

হবসের মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রাক-সামাজিক পরিবেশের মধ্যে বাস করত, যাকে বলে প্রকৃতির রাজ্য।  এই অবস্থায় মানুষ ছিল স্বার্থপর, লোভী, নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী ও কলহপ্রিয়। এই পরিবেশে মানুষ স্বাধীন ছিল বটে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা ছিল প্রকৃতপক্ষে এক নিয়ন্ত্রণহীন যথেচ্ছাচারিতা। 'জোর যার মুলুক তার' নীতিই ছিল তাদের একমাত্র ধর্ম। এই অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার পরিবেশে প্রতিটি মানুষ স্বীয় স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতালাভের পিছনে ধাবিত হওয়ার ফলে আদিম মানুষের মধ্যে চলত এক বিরামহীন সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির রাজ্য রূপান্তরিত হল এক নিদারুণ যুদ্ধাবস্থায়। হবস্ এই অবস্থাকে 'প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের লড়াই" বলে উল্লেখ করেছেন। এক কথায় প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন ছিল 'নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও স্বপ্নায়ু। 

এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদন করে সমস্ত ক্ষমতা কোনো এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে তুলে দিল। হবসের মতে, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে ক্ষমতা অর্পিত হল তিনিই হলেন সার্বভৌম। চুক্তির মাধ্যমে যে সার্বভৌম কর্তৃত্ব জন্মলাভ করল তার ক্ষমতা হল চরম, নিরঙ্কুশ ও অবাধ। সকলে তাঁর প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য। তবে সার্বভৌম কর্তৃত্ব যেহেতু চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেনি সেহেতু  কোনো শর্ত দ্বারা সার্বভৌম শক্তি সীমিত নয়। আইন হল সার্বভৌমের আদেশেরই এক আনুষ্ঠানিক রূপমাত্র। এই আইনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠল রাষ্ট্রীয় সমাজ এবং সুরক্ষিত হল মানুষের জীবন।


প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়। যেমন-

প্রথমত, মানুষ যখন চুক্তি সম্পাদন করে, তখন সার্বভৌমের কোনো উপস্থিতি সেখানে ছিলনা। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যে- সমতা ভোগ করত, সেই সমতার ভিত্তিতেই তারা চুক্তি সম্পাদন করেছে। চুক্তির পরিণতি হিসেবে সার্বভৌমের আবির্ভাব ঘটেছে। চুক্তির আগে সার্বভৌমের অস্তিত্ব ছিলনা। সার্বভৌম চুক্তির অলীকৃত হননি, তিনি ছিলেন চুক্তির ঊর্ধ্বে। জনগণ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌম শক্তি সৃষ্টি করেছিল। 

দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যারা অংশগ্রহণ করেনি, সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ সার্বভৌমের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেনা। সার্বভৌম ক্ষমতা কার হাতে অপর্ণ করা হবে, এ ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতামত প্রাধান্য পেয়েছিল এবং তা চুক্তির অংশে পরিণত হয়েছিল। 

তৃতীয়ত, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল এবং এটিও ছিল চুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্যই সার্বভৌম সংস্থাকে অসীম ক্ষমতা এবং অবাধ ও স্বেচ্ছাধীন কার্যকলাপের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। 


সমালোচনাঃ

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

১) অযৌক্তিক ধারনাঃ

হস-বর্ণিত প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল বন্য, হিংস্র, সংঘাতপ্রবণ, ও হৃদয়হীন। অথচ সেই মানুষ হঠাৎ যুক্তিপ্রবণ, বিচার-বোধসম্পন্ন এবং উন্নত আইনগত চেতনার অধিকারী হয়ে উঠে চুক্তি সম্পাদন করতে পারে—এ কথা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। তাই অনেকের মতে, তাঁর বক্তব্য অযৌক্তিক এবং কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না।

২) অবাস্তব ধারনাঃ

সাধারণত সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার আইনগত ও সুশৃঙ্খল পরিবেশেই চুক্তি সম্পাদন সম্ভব। কিন্তু হবসের মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পূর্বের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এরূপ ঘটনাকে ঘোড়ার গাড়িতে ঘোড়ার সামনে গাড়ি রাখার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর সেজন্যই হবসের বক্তব্যকে নিতান্তই অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে সমালোচনা করা হয়।

৩) রাষ্ট্রীয় চরমতাবাদঃ

সামাজিক চুক্তি-সংক্রান্ত হবসের ধারণায় সার্বভৌম কর্তৃপক্ষকে চুক্তির ঊর্ধ্বে রেখে তাকে অবাধ চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী করে তোলা হয়েছে। অনেকের মতে, নিজেদের মধ্যে চুক্তি সীমাবদ্ধ রেখে এবং চুক্তির ঊর্ধ্বে এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করে প্রকৃতির রাজ্য পরিত্যাগকারী মানুষ আরও ভয়ংকর অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। এর দ্বারা হবস রাষ্ট্রীয় চরমতাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।

৪) একপাক্ষিক চুক্তিঃ

যে-কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নূন্যতম দুটি পক্ষের দরকার হয়। অথচ হবসের সামাজিক চুক্তিতে একটি পক্ষের মধ্যেই চুক্তি সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের চুক্তি শুধু অবাস্তবই নয়, সম্পূর্ণরূপে অনৈতিহাসিক।

৫) আইনগত সার্বভৌমিকতার উপর গুরুত্ব আরোপঃ

হবস্ কেবলমাত্র আইনগত সার্বভৌমিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন; তিনি রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন।


মূল্যায়নঃ

উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। তাঁর চুক্তিবাদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাকে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার পথপ্রদর্শক বলা যেতে পারে। তিনি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হিসেবে চুক্তি- সংক্রান্ত ধারণা উপস্থাপন করেছেন।

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস


(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


Main Menu


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code