ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; historical materialism

Ad Code

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; historical materialism

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ


ভূমিকাঃ

মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদরাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে মানব সমাজের বিকাশের ধারাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।


মার্কসের মতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদঃ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদেরই অংশ। মানবসমাজ ও তার ইতিহাসের প্রকৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বের প্রয়োগকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। স্তালিন এর অভিমত অনুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল নীতিগুলিকে সমাজজীবনের অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে।

মূল বক্তব্যঃ

কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করা। কার্ল মার্কস তাঁর 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নামক গ্রন্থে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাস কেবলমাত্র কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংকলন বা কাহিনির বিন্যাস নয়। ইতিহাসের কোনো ঘটনা অন্য ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত মূল বিষয়গুলির কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন-

i) ভিত্তিকাঠামো এবং উপরিকাঠামো

মার্কসবাদ অনুযায়ী অর্থনীতি হল সমাজের মূল ভিত্তি বা চালিকাশক্তি। এই অর্থনৈতিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, ধর্ম সাহিত্য, কলা ইত্যাদি সামাজিক উপরিকাঠামোগুলি। মার্কসবাদ অনুযায়ী মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন এলেই উপরিকাঠামোরও পরিবর্তন আসবে।

ii) সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি

কার্ল মার্কসের মতে, উৎপাদনের উপায় এবং পদ্ধতির উপরে মানুষের বৈষয়িক জীবনযাত্রা নির্ভর করে। মানবসমাজের মৌলিক পরিবর্তনের মূল কারণ হল উৎপাদন পদ্ধতিতে তার ভূমিকা। তিনি দেখিয়েছেন যে, উৎপাদন পদ্ধতি হল সমস্ত কিছুর মূল চালিকাশক্তি। এই উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক বর্তমান। যথা- উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক।

iii) উৎপাদন ব্যবস্থার ভারসাম্য

কার্ল মার্কস বলতে চেয়েছেন যে, উৎপাদন শক্তির মধ্যে পরিবর্তন এলে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে যদি সুসংগতি বা ভারসাম্য বাজায় থাকে তাহলে আদর্শ অর্থাৎ শোষণহীন উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

iv) সমাজ পরিবর্তনের কারণঃ

কার্ল মার্কসের মতে, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক -এই দুই উৎপাদন পদ্ধতির দ্বন্দ্বেই সমাজ পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কস বলেছেন, আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদনের উপর কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না তাই শ্রেণিভেদ বা শ্রেণীশোষণ ছিলনা। কিন্তু পরবর্তীকালে দাস সমাজে দাস মালিকরা উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করে তারপর কালক্রমে বিপ্লব বা বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমে সামন্তপ্রভু এবং পরে পুঁজিপতিদের হাতে তা চলে আসে। এই সময়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন পদ্ধতির দুটি অংশের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ চলতেই থাকে। এইভাবে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন ঘটে।

v) ইতিহাসের গতিবিধিঃ

মার্কস দেখিয়েছেন যে, কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাই দীর্ঘকাল এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকেনা, তা ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে চলে। মানব ইতিহাসে প্রথম উৎপাদনমূলক এবং শোষণমুলক সমাজ দেখা যায় দাস সমাজে। এই সমাজে দাস প্রভুরা সব কিছুর মালিক, দাসরা কেবল উৎপাদনকারী, বিনিময়ে তারা লাভ করে সামান্য মজুরি। শোষণ-বঞ্চনার কারণে সেই সমাজ পরিবর্তিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। এইভাবে ক্রমবিবর্তনের সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং ধনতান্ত্রিক সমাজ থেকে রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ।


সমালোচনাঃ

মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও এর সমালোচনাও কোনো অংশে কম নয়। নীচে মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-

i) সমাজ বিকাশের ভূল ব্যাখ্যাঃ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদে সমাজ বিকাশ বা ইতিহাসের অগ্রগতির কারন হিসাবে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটেনি, তা ঘটেছে এককভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ফলে।

ii) মানুষের ভূমিকা অস্বীকারঃ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সব কিছু নির্ধারিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মানুষের কিছু করার নেই। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকাশে মানুষের ভূমিকাকে কখনই অস্বীকার করা যায়না।

iii) উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরকঃ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদে  উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা প্রতিক্রিয়ার ফলে সমাজ বিকাশের কথা বলা হয়েছে। সমালোচকদের মতে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক হল একে অপরের পরিপূরক, তাই এই দুটির মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব হতে পারেনা

iv) অর্থনৈতিক উপাদানের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপঃ

সমালোচকদের মতে, মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উপাদানের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, কিন্তু অর্থনৈতিক উপাদান এককভাবে ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেনা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোচনায় ধর্ম, সংস্কৃতি সহ অন্যান্য উপাদানগুলিকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

v) শ্রেণী সহযোগিতা উপেক্ষিতঃ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শ্রেণী-দ্বন্দ্বকেই স্বীকার করে। কিন্ত সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে শ্রেণী- দ্বন্দ্বই শেষ কথা নয়। শ্রেণীদ্বন্দ্বর মত শ্রেণী  সহযোগিতার বিষয়টিও কোনো অংশে কম  নয়। যা মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদে অস্বীকার করা হয়েছে।

মূল্যায়নঃ

    উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারন মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইতিহাসের সব ঘটনার পশ্চাতে কোনো না-কোনো ভাবে অর্থনীতি প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের গুরুত্ব ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। 

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ

এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস


(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


Main Menu

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code