ফ্যাসিবাদ; সংজ্ঞা, প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা

Ad Code

ফ্যাসিবাদ; সংজ্ঞা, প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা

 ফ্যাসিবাদ


ভূমিকাঃ

মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ হল একটি নগ্ন, প্রতিক্রিয়াশীল, মানবতাবিরোধী অধ্যায়। এক চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ইটালিতে বেনিটো মুসোলিনির হাত ধরে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। প্রায় একই সময়ে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদ জন্ম নেয়। এই দুই মতবাদের মধ্যে মৌলিক মিল থাকায় দুটিই 'ফ্যাসিবাদ' নামে পরিচিত।

সংজ্ঞাঃ

সাধারনভাবে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ একটিমাত্র রাজনৈতিক দল এবং সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়, তাকে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থা অথবা ফ্যাসিবাদ বলে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় জনগণের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। মুসোলিনির আমলে ইটালি এবং হিটলারের আমলে জার্মানি ফ্যাসিবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

রজনী পাম দত্তের মতে, ফ্যাসিবাদ হল বড়ো শিল্পপতি, জমিদার ও পুঁজিপতিদের অর্থসাহায্যে পুষ্ট এবং তাদের নির্দেশে পরিচালিত এমন এক পাতি-বুর্জোয়া শ্রেণির আন্দোলন, যার মূল উদ্দেশ্য হল শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবকে পরাজিত করা এবং যাবতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া।

প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

        ফ্যাসিবাদের উপরিক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বিশিষ্টগুলি উল্লেখ করা যায়। যেমন-

i) সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণাঃ

ফ্যাসিবাদ মূলত সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষপাতী। হেগেল এর সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণাকে ভিত্তি করেই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি। ফ্যাসিবাদের জন্য ব্যক্তি বলিপ্রদত্ত বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ জনগণের বিবেক হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। 

ii) জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনঃ

ফ্যাসিবাদে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কথাও বলা হয়। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটি ফ্যাসিবাদী একনায়করা জনগণের কাছে বারবার প্রচার করেন। জার্মানের রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে তীব্র প্রচার চালিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, জার্মানরা খাঁটি আর্য, তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। প্রতিটি জার্মানের উচিত তাদের জাতি-রাষ্ট্রকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করা।

iii) একদলীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্বঃ

ফ্যাসিবাদে একদলীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জাতির বা রাষ্ট্রীয় জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধনের ব্যাপারে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কের একক দলই যথেষ্ট বলে ফ্যাসিবাদ মনে করে। ফলে বিরোধী দলের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে একক দলের সার্বিক প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনে গ্রেফতার বা হত্যা পর্যন্ত করা হয়।

iv) উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠাঃ

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ হল ফ্যাসিবাদের প্রধান ভিত্তি। জাতীয়তাবাদের উগ্রতা এতটাই ছিল যে হিটলার জার্মান জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, বিশুদ্ধ জাতি হিসাবে ঘোষণা করেন এবং আর্য জাতি হিসাবে জার্মানদেরই একমাত্র অধিকার আছে অনার্য সহ অন্যান্য জাতিগুলিকে শাসন করার। অন্যদিকে মুসোলিনি বিশ্বশান্তিকে 'কাপুরুষের স্বপ্ন' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করতেন, স্ত্রীলোকের কাছে মাতৃত্বই যেমন একমাত্র কাম্য, পুরুষের কাছে যুদ্ধও একই রকমের বিষয়।

v) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধিতাঃ

এই মতবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। মনে করে যে, রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান, ব্যক্তির কাজ সেই সর্বশক্তিমানের কাজে আত্মবলিদান করা, তবে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সেখানে কোনো দাম নেই। ফ্যাসিবাদ আরও মনে করে যে, ব্যক্তির স্বার্থ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে স্বীকার করা হয় না।

সমালোচনাঃ

        রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। নীচে ফ্যাসিবাদের গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-

i) সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকঃ

ফ্যাসিবাদী বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক। জনগণের সার্বভৌমত্ব ফ্যাসিবাদে অস্বীকৃত। এখানে রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান, চরম ও অভ্রান্ত। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা বাছাই করা কিছু ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। ফ্যাসিস্ট দল ছাড়া অন্য সকল রাজনীতিক দলের অস্তিত্বকে বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়। সব রকম বিরোধিতা ও সমালোচনাকে সন্ত্রাসমূলক পথে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদের মূল মন্ত্র হল এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক দল ও এক নেতা। বস্তুত গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও শাসনব্যবস্থার বিরোধিতাই হল ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি।

ii) ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধীঃ

ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্পর্কে ফ্যাসিবাদী ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। ফ্যাসিবাদে স্বাধীনতার উপলব্ধির জন্য রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও স্বার্থের কাছে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেই ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। বস্তুত ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের দাসত্বকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

iii) সাম্রাজ্যবাদী মতবাদঃ

ফ্যাসিবাদ যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। জাতীয় রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের স্বার্থে যুদ্ধ হল স্বাভাবিক ও শাশ্বত নিয়ম। ফ্যাসিবাদে উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করা হয়। সুতরাং ফ্যাসিবাদ হল আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও মৈত্রীর আদর্শের বিরোধী এবং মানবসভ্যতার শত্রু।

iv) সাম্য-বিরোধীঃ

ফ্যাসিবাদ সাম্যের আদর্শের বিরোধী। রাজনীতিক সাম্য এবং জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাম্য এখানে অস্বীকৃত। ফ্যাসিবাদে সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভূতি  সকল ক্ষেত্রে সাম্যের আদর্শকে উপেক্ষা করে বীরপূজা, ব্যক্তিপূজা, আভিজাত্য, জাতিবিদ্বেষ প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

v) প্রচলিত মূল্যবোধকে অস্বীকারঃ

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে একনায়ক তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মিথ্যাপ্রচার, বাগাড়ম্বর, প্রতারণা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। তা ছাড়া প্রচলিত যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা ও ধ্বংস করা হয়। এই কারণে উদারনীতিক চিন্তাবিদদের কাছে ফ্যাসিবাদ হল মানবতাবিরোধী মতবাদ।

মূল্যায়নঃ

বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসিবাদ এক নিকৃষ্ট ধরনের একনায়কতন্ত্র ব্যতীত কিছুই নয়। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী; সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সংগঠন ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধবাদকে ফ্যাসিবাদ প্রশ্রয় দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদকে আহ্বান জানায়। এই তত্ত্ব মানবতা বিরোধী এবং বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। 


লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রথম অধ্যায়

১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)


৪) রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)


৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)


৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।


৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)


৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)


১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। একত্ববাদী তত্ত্বের মূখ্য প্রবক্তা কারা? ১০ (২০১৯), ১০ (২০২২)


৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)

তৃতীয় অধ্যায়

১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।


২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)


৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

চতুর্থ অধ্যায়

১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।


২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


৩)  নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)


৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)

পঞ্চম অধ্যায়

১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)


২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)


৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)


৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)


৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

Main Menu



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code