নৈরাজ্যবাদ
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার
ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল নৈরাজ্যবাদ। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার
সূচনাপর্বেই এর বীজ নিহিত থাকলেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর বিকাশ ঘটে। নৈরাজ্যবাদের
প্রবক্তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন- গডউইন, হজস্কিন,
প্রুধো,
ওয়ারেন,
বাকুনিন,
থোরো,
টলস্টয়,
ক্রোপটকিন
প্রমুখ।
সংজ্ঞাঃ
বাংলা নৈরাজ্যবাদ বা ইংরেজী 'Anarchism'
শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘Anarchia' থেকে,
যার অর্থ হল শাসনহীনতা বা 'no rule'।
অর্থাৎ শব্দগত দিক থেকে নৈরাজ্যবাদ হল শাসনহীনতা বা রাষ্ট্র বিরোধী মতবাদ। এই
মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। সুতরাং রাষ্ট্রের অবসান অভিপ্রেত। নৈরাজ্যবাদের
ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। ইতিবাচক অর্থে নৈরাজ্যবাদ বলতে সমাজের এমন এক
সহযোগিতামূলক অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে
আইনকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিলুপ্ত করা হয়। নেতিবাচক অর্থে শাসন,
আইন
ও কর্তৃপক্ষের বিরোধিতাই হল নৈরাজ্যবাদ। নৈরাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য— শুধুমাত্র
কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা নয়, কর্তৃত্বের
বিরুদ্ধে ক্রমাগত সংগ্রাম করা। তবে নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরোধীতা করলেও
রাষ্ট্র বা সরকারের সম্পূর্ণ অবসানের কথা বলেননি।
ক্রোপটকিনের
অভিমত অনুযায়ী নৈরাজ্যবাদ হল জীবনের একটি নীতি বা মতবাদ। এই মতবাদে এমন এক
সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয় যেখানে সরকারের কোন জায়গা নেই।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
নৈরাজ্যবাদের উপরিউক্ত সংজ্ঞার
পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন-
i) রাষ্ট্র অনাবশ্যকঃ
নৈরাজ্যবাদীদের
মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি অনাবশ্যক প্রতিষ্ঠান। মানবসমাজে রাষ্ট্র এমন কোন কাজ
করে না, যা রাষ্ট্র না থাকলে
সম্পাদিত হবেনা। রাষ্ট্র দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে এবং বৈদেশিক আক্রমণ
প্রতিহত করে। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র সামরিক বাহিনী সংগঠিত ও সংরক্ষণ করে।
নৈরাজ্যবাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসানের পরও এই একই কাজ আরও
ভালোভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত ভাড়াটে সৈনিক বা বেতনভুক
সৈনিকদের থেকে নাগরিকদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনী অনেক বেশি কার্যকর ও
নির্ভরযোগ্য।
ii) রাষ্ট্র শোষণমূলক ও পীড়নমূলকঃ
নৈরাজ্যবাদীরা
রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রেণী-চরিত্রের
কারণেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রকট হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র হল একটি শোষণমূলক ও
পীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকশ্রেণীর উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম করার উদ্দেশ্যে
পুঁজিপতি শ্রেণী এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করে।
iii) অপরাধ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্র দায়ীঃ
রাষ্ট্র
সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। পুলিশ বাহিনী, আইন-আদালত,
কারাগার
প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারসমূহ সমাজে অন্যায়-অবিচার প্রতিহত করার পরিবর্তে
অন্যায়-অবিচারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে রাষ্ট্র তার ভূমিকার
মাধ্যমে অপরাধীতে পরিণত করে এবং অপরাধীকে শাস্তি দেয় অপরাধের কারণে। রাষ্ট্র
ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেনা। এই অবস্থায় একজন সাধারণ অপরাধী দাগী আসামীতে
পরিণত হয়।
iv) ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধীঃ
নৈরাজ্যবাদীরা
ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী। তাঁদের মতে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় মূল কারণ হল ব্যক্তিগত
সম্পত্তি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতেই সমাজব্যবস্থায় ‘আমার-তোমার’ বোধের
সৃষ্টি হয়। এবং এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজজীবনে
ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির
ধারণার ভিত্তিতে পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির
ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে
v) ধর্মের বিরোধিতাঃ
নৈরাজ্যবাদীরা
ধর্ম ও চার্চের বিরোধিতা করেন। তাঁরা কোন রকমের কর্তৃত্বকে স্বীকার বা সমর্থন
করেননা। তাঁরা সকল রকম কর্তৃত্বের অবসানের কথা বলেন। ধর্ম মানুষকে
কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে। পুঁজিপতি ও রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের অন্যায় অবিচারের ব্যাপারে
ধর্ম মানুষকে সহিষ্ণু করে তোলে। ধর্ম রক্ষণশীল ও প্রগতি-বিরোধী। ধর্ম বা চার্চের
কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ অবসান ব্যতিরেকে সামাজিক প্রগতি অসম্ভব
সমালোচনাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে নৈরাজ্যবাদ
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও এর সমালোচনাও কোনো অংশে কম নয়। নীচের
নৈরাজ্যবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-
i) রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ অপরিহার্যঃ
নৈরাজ্যবাদীরা
রাষ্ট্রের বদলে স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। কিন্তু স্বেচ্ছামূলক
সংগঠনসমূহ রাষ্ট্রের সকল কাজকর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে না। সুস্থ ও স্বাভাবিক
জনজীবনের স্বার্থে এমন কিছু কিছু কাজকর্ম আছে, যা
সম্পাদন করা রাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্য কোন সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং
স্বাভাবিক সমাজ জীবনের স্বার্থে কোন-না-কোন এক ধরনের কর্তৃপক্ষের অস্তিত্বের
প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।
ii) রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সর্বক্ষেত্রে পীড়নমূলক নয়ঃ
নৈরাজ্যবাদী
মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে পীড়নমূলক বলে
অভিযুক্ত করা হয়েছে। নৈরাজ্যবাদীদের এই অভিযোগও অতিরঞ্জিত। রাষ্ট্র তাঁর কার্য
সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক উপায়-পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতামূলক
পন্থা-পদ্ধতি অনুসরণ করে। সামাজিক পরিষেবামূলক কাজকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বলপ্রয়োগ করেনা।
iii) অবাস্তবত ধারণাঃ
সমালোচকদের
অভিযোগ অনুসারে নৈরাজ্যবাদ অবাস্তবতা দোষে দুষ্ট। নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার যে
চিত্র চিহ্নিত হয়েছে তা বাস্তবে রূপায়িত করা এক রকম অসম্ভব। নৈরাজ্যবাদীরা
বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন ও বহুগোষ্ঠী সমন্বিত সমাজে সমন্বয় সামঞ্জস্য
স্বাভাবিকভাবেই বজায় থাকবে। কিন্তু এই ধারণা বহুলাংশে কাল্পনিক। কারন সমাজে বহু ও
বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকলে গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিবাদ-সংঘাতের সৃষ্টি হবেই এবং সে
ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
iv) কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়ঃ
নৈরাজ্যবাদীদের
অভিমত অনুসারে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে মৌলিক বিরোধিতা বর্তমান। কিন্তু
নৈরাজ্যবাদীদের এই ধারণা সঠিক নয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বই সমাজে স্বাধীনতাকে নিরাপদ
ও নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে বলবান ও বিত্তবানেরাই স্বাধীনতা ভোগ
করবে। রাষ্ট্রহীন রাজত্বে 'জোর
যার মূলুক তার এই বন্য বিধান কায়েম হবে।
v) আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র দরকারঃ
আধুনিক
সমাজের সমস্যাসমূহ বহু, বিভিন্ন
এবং অতিমাত্রায় জটিল প্রকৃতির। এই সমস্ত সমস্যার সম্যক সমাধানের স্বার্থে বিশেষ
ধরনের বিচক্ষণতা বা সামর্থ্য আবশ্যক। এছাড়া মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর।
মানুষের এই স্বার্থপরতার মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অপরিহার্যতা
অনস্বীকার্য।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে নৈরাজ্যবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। নৈরাজ্যবাদীরা জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ আয়োজনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ধরনের সহযোগিতা ও উদ্যোগ আয়োজন সামাজিক উন্নয়ন ও প্রগতির সহায়ক।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)
৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)
৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)
৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)
তৃতীয় অধ্যায়
১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৩) নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)
৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)
৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)
৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ