জনগণের সার্বভৌমিকতা; সংজ্ঞা, সমালোচনা

Ad Code

জনগণের সার্বভৌমিকতা; সংজ্ঞা, সমালোচনা

 জনগণের সার্বভৌমিকতা


ভূমিকাঃ

        চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবেই জনগণের সার্বভৌমিকতা সংক্রান্ত তত্ত্বের সৃষ্টি হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী লেখকগণই এই তত্ত্বের মুখ্য প্রবক্তা। 'সার্বভৌমিকতার প্রকৃত অধিকারী হল জনগণ, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং জনগণের নির্দেশই হল আইন। রাষ্ট্রের এলাকার ভিতরে এই গণশক্তির উপরে আর কোনও ঊর্ধ্বতন শক্তি নেই।

মূল বক্তব্য ও সংজ্ঞাঃ

        জনগণের সার্বভৌমিকতা মতবাদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদ নয়, চূড়ান্ত বিচারে জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী, প্রকৃত উৎস। জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং জনগণের নির্দেশই হল আইন। রাষ্ট্রের মধ্যে এমন কোনে ঊর্ধ্বতন শক্তি নেই যা এই গণশক্তির উচ্চে স্থান পেতে পারে।

        জনগনের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন- লক, রুশো, রিচি, লর্ড ব্রাইস প্রমূখ।

        লকের মতে, জনগণই হল চরম ক্ষমতার অধিকারী। জনগনের ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রনীত হয়। শাসক জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তাঁদের ইচ্ছা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

রুশোর মতে, জনগণের কল্যাণকামী সমষ্টিগত ইচ্ছা বা সাধারণ ইচ্ছাই হল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের অধিকারী। এ সার্বভৌম ক্ষমতা চরম, অভ্রান্ত ও অহস্তান্তরযোগ্য। রুশোর মতে, “জনগণের বাণীই ঈশ্বরের বাণী"

রিচির মতে, জনগণের সম্মিলিত ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে কোনো সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। সরকারের সঙ্গে জনগণের বিরোধ বাধলে শেষ পর্যন্ত জনশক্তির জয় অনিবার্য।

রিচির ন্যায় লর্ড ব্রাইসও জনগণের সার্বভৌমিকতাকে 'গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূলমন্ত্র' বলে উল্লেখ করেছেন।

লর্ড ব্রাইস এর মতে, জনগনের সার্বভৌমিকতা গণতন্ত্রের বনিয়াদ ও নীতিবাক্যস্বরূপ

এছাড়া উদারনীতিবাদ ও মার্কসীয় মতবাদে জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণাটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব এবং চিনের গণবিপ্লব জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক একটি ধাপ বলে চিহ্নিত করা হয়।

সমালোচনা

জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্ব পূর্ণ সমালোচনাগুলি হল-

১) অস্পষ্ট ধারনাঃ

জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট। 'জনগণ' বলতে ঠিক কী বোঝায় বা কাদের বোঝায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অধ্যাপক গার্নার বলেছেন, “যাঁরা জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করতে চান, তাঁরা জনগণ বলতে ঠিক কী বোঝান তা স্পষ্ট করেন না" প্রকৃতপক্ষে জনগণ বলাতে যদি দেশের অভ্যন্তরে সকল মানুষকে বোঝায় তাহলে সেই অসংগঠিত জনগণকে সার্বভৌম বলা যায় না। কারণ সার্বভৌমত্ব সুসংগঠিত এবং সুসংবদ্ধ।

২) অযৌক্তিক ধারনাঃ

        জনগনের সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অযৌক্তিকও বটে। যে-কোনো দেশের সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র জনগণ নয়, জনগণের একটি অংশমাত্র অংশগ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া নির্বাচকমণ্ডলীও বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে বিভক্ত থাকে। তাই অনেক সময় দেখা যায়, জনগণের অতি সামান্য অংশের ভোট পেয়ে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলে এবং সরকার গঠন করে। সুতরাং এক্ষেত্রেও গণসার্বভৌমিকতার প্রকৃত প্রকাশ ঘটে না।

৩) আইনগত ভিত্তি নেইঃ

সার্বভৌমিকতা একটি আইনগত ধারণা এবং আইনসম্মত পদ্ধতিতেই এই ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জনগনের সার্বভৌমিকতার ধারনায় যে জনগনকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে বর্ণনা করা হচ্ছে তাঁর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কারন জনমত অসংগঠিত অধ্যাপক গার্নার এর মতে, অসংগঠিত জনমত, যত শক্তিশালীই হোক না কেন তা সার্বভৌমত্ব নয়, যদি না তা আইনি আকার পরিধান করে

৪) স্ববিরোধী ধারনাঃ

অনেকে বিপ্লবের দ্বারা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতাকে সার্বভৌমিকতা বলতে চান। কিন্তু বিপ্লব যেহেতু আইনসঙ্গত হতে পারে না, তাই এটি কখনো সার্বভৌমও হতে পারে না। এই কারণেই অধ্যাপক গেটেল জনগণের সার্বভৌমিকতাকে 'স্ববিরোধী শব্দ' বলে মন্তব্য করেছেন।

৫) অবিভাজ্য নয়ঃ

সার্বভৌমিকতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল অবিভাজ্যতা।জনগনের সার্বভোউমিকতার ধারনায় সার্বভৌম ক্ষমতা অবিভাজ্য নয়, কারন জনগণ নানা মতে নানা দলে বিভক্ত। ফলে গণসার্বভৌমিকতার দাবিকে স্বীকার করতে হলে বিভিন্ন মতাবলম্বী জনগণের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতাকে বিভক্ত করে দিতে হয়।

মূল্যায়ন

জনগনের সার্বভৌমিকতার ধারনার বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালচনাগুলি উল্লেখ করা হলেও এর গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না।শাসনব্যবস্থার ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার ব্যাপারে এই তত্ত্বটি খুবই সহায়ক।বর্তমানে ভোটাধিকার, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা, স্বায়ত্তশাসন, গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব বাস্তব রূপ লাভ করেছে

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রথম অধ্যায়

১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)


৪) রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)


৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)


৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।


৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)


৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)


১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। একত্ববাদী তত্ত্বের মূখ্য প্রবক্তা কারা? ১০ (২০১৯), ১০ (২০২২)


৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)

তৃতীয় অধ্যায়

১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।


২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)


৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

চতুর্থ অধ্যায়

১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।


২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


৩)  নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)


৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)

পঞ্চম অধ্যায়

১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)


২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)


৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)


৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)


৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

Main Menu



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code