অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব Aristotle theory of state

Ad Code

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব Aristotle theory of state

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব 


ভূমিকাঃ

        পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অ্যারিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তার রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর লেখা দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল- পলিটিকস এবং নিকোমাসিয়ান এথিকস। তাঁর সমগ্র রাষ্ট্র চিন্তার মধ্যে অন্যতম হল রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা।

অ্যারিস্টটলের মতে রাষ্ট্রঃ

        অ্যারিষ্টটলের মতে, রাষ্ট্র হল একটি সর্বোচ্চ, স্বাভাবিক এবং জৈবিক সংগঠন। সর্বোচ্চ সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রের কাজ হল সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করা। প্রত্যেক সংগঠন যেমন কল্যাণ সাধনের জন্য গড়ে ওঠে তেমনি রাষ্ট্রও কল্যাণ সাধনের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।


রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ

অ্যারিস্টটলের মতে রাষ্ট্রের উৎস নিহিত রয়েছে দুটি মৌলিক ও স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে একটি হল পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্ক, আর অপরটি হল প্রভুর সাথে ভূত্যের সম্পর্ক। এই দুটি সম্পর্কের যোগফালে গড়ে ওঠে পরিবার; যা মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায়। ক্রমে মানুষের প্রয়োজন বাড়ে এবং এই বর্ধিত প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্য কতকগুলি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠে গ্রাম। পরিবারের থেকে গ্রাম অপেক্ষাকৃত অধিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হলেও, মানুষের সকল প্রকার প্রয়োজন মেটাতে পারে না। মানুষের সমস্ত প্রকার চাহিদা মেটানোর জন্য এবং তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য কতকগুলি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠে রাষ্ট্র।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

        রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে উপরিউক্ত ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যারিস্টটলের  রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তার  নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায়। যেমন-

i) রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানঃ

অ্যারিস্টটলের মতে রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান এটা কোনো চুক্তির ফসল নয়। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে গড়ে উঠেছে পরিবার এবং তার থেকে গড়ে উঠেছে গ্রাম ও রাষ্ট্র। পরিবার ও গ্রাম যেহেতু স্বাভাবিক, সেহেতু রাষ্ট্রও একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান।

ii) রাষ্ট্র একটি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানঃ

অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রই হল সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। তিনি দেখিয়েছেন যে, পরিবার বা গ্রামের পরিধি সংকীর্ণ এবং সেগুলির লক্ষ্যও সীমাবদ্ধ। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিধি ব্যাপক এবং সর্বোচ্চ কল্যাণসাধন হল এর উদ্দেশ্য।

iii) রাষ্ট্র ব্যক্তির পূর্ববর্তীঃ

সময় বা কালানুক্রম বিচারে ব্যক্তি রাষ্ট্রের পূর্ববর্তী। কিন্তু গুরুত্ব এবং যৌক্তিকতার দিক থেকে রাষ্ট্র ব্যক্তির অগ্রবর্তী। কারণ, রাষ্ট্র হল সমগ্র, আর ব্যক্তি এই সমগ্রেরই অংশমাত্র। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, অংশ কখনোই সমগ্রের আগে স্থানলাভ করতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্র হল ব্যক্তির অগ্রবর্তী।


iv) রাষ্ট্র জীবদেহ স্বরূপঃ

অ্যারিস্টট্ল রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে জৈব মতবাদে বিশ্বাসী। তার মতে, জীবদেহের সঙ্গে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যেমন একটি অটুট বন্ধন আছে, তেমনি রাষ্ট্রের কাঠামোর সঙ্গে তার অঙ্গস্বরূপ ব্যক্তিরও একটি সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে।

অ্যারিস্টটলের মতে, জীবদেহের অংশগুলি দু-ধরনের, যথা-

ক) অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং

খ) সাহায্যকারী অংশ।

হাত, পা, মাথা প্রভৃতি অবিচ্ছেদ্য অংশ শরীরের কার্যকলাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। অপরদিকে হাড়, মাংস, রক্ত প্রভৃতি সাহায্যকারী অংশ শরীরের প্রধান প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুসঞ্চালন ও শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

অনুরূপভাবে, রাষ্ট্রের মধ্যে শাসনবিভাগ, সামরিক বাহিনী, আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নাগরিকবৃন্দ তার অচ্ছেদ্য অঙ্গস্বরূপ। অন্যদিকে, কারিগর, শ্রমজীবী, ক্রীতদাস প্রভৃতি হল রাষ্ট্রের সাহায্যকারী অংশস্বরূপ।

v) নৈতিকতাঃ

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রতত্ত্ব অনেকটা নৈতিকতায় মণ্ডিত। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মধ্যেই মানুষের নৈতিকতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটে। রাষ্ট্রনৈতিক আনুগত্য বাইরে থেকে আরোপিত কোনো বিষয় নয়। নৈতিকতার কারণেই মানুষকে রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলতে হয়। মানুষের অন্যতম কর্তব্য হল মঙ্গলময় জীবনযাপনের লক্ষ্য সুনিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের মধ্যেই এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব।

vi) সম্ভাব্য সর্বোত্তম রাষ্ট্রঃ

অ্যারিস্টটল তাঁর "Politics' গ্রন্থে একটি সুন্দর আদর্শ রাষ্ট্রীয় জীবনের কতকগুলি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-

অ্যারিস্টটলের মতে, আদর্শ রাষ্ট্র হতে গেলে তার শাসকগণ হবেন জ্ঞানী এবং সদগুণ সম্পন্ন। অবশ্য বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণতান্ত্রিক শাসনকে, যাকে তিনি পলিটি (Polity) বলে উল্লেখ করেছেন।

আদর্শ রাষ্ট্রের এলাকা এমন হবে যাতে তা সহজে শত্রুর কবলে না আসতে পারে। জনসংখ্যার প্রশ্নে তিনি মাঝারি আয়তন বিশিষ্ট জনসংখ্যায় আস্থাশীল ছিলেন। ভূখণ্ডের মতো জনসংখ্যার আয়তনও যেন খুব বেশি বা খুব কম না হয় সেদিকে তিনি নজর দিতে বলেছেন। সর্বোপরি অ্যারিস্টটল জনগণের সংখ্যা অপেক্ষা গুণাবলির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

বস্তুগত শর্তের পাশাপাশি অ্যারিস্টটল কতকগুলির নৈতিক শর্তপূরণের ওপর জোর দিয়েছেন। সেজন্য একটি বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন।


সমালোচনাঃ

        অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

       

i) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ভুল ব্যাখ্যাঃ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যার ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। পরিবারই যে রাষ্ট্রসমাজের আদিমতম রূপ এ কথা মেনে নেওয়া যায় না।

ii) রাষ্ট্র সর্বচ্চ প্রতিষ্ঠান নয়ঃ

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র চিন্তায় রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজে রাষ্ট্র প্রধান সংগঠন সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভূতি সংগঠন আছে। সমাজ জীবনে এদের গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়।

iii) স্ববিরোধীতাঃ

        অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় স্ববিরোধীতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তিনি একদিকে বলেছেন পরিবার বা গ্রাম থেকে স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিকে সমগ্রের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রকে পরিবার বা গ্রাম তথা ব্যাক্তির পূর্ববর্তী সংগঠন হিসাবে তুলে ধরেছেন।

iv) রাষ্ট্রের জৈবতত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণঃ

        অ্যারিস্টটল জীবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রকে অহেতুক তুলনা করে  রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছেন। জৈব তত্ত্বের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা ভুলে গিয়েছেন।

v) রাষ্ট্রের নৈতিক ধারনাঃ

        কোনো কোনো সমালোচকের মতে, বাস্তববাদী হলেও অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা নৈতিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সমকালীন রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলা অ্যারিস্টটলের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

মূল্যায়নঃ

উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধ্যান ধারনার গুরুত্বকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায়না। বর্তমানের জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাটি বহু আগেই অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় স্থান পেয়েছিল।

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ

এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস


(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-


Main Menu


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code