প্রশ্ন-১; উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
প্রশ্ন-২; সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
উত্তরঃ
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রের
উৎপত্তি ও প্রকৃতি সংক্রান্ত যতগুলি মতবাদ প্রচলিত আছে তাঁর মধ্যে অন্যতম হল উদারনৈতিক
রাষ্ট্রতত্ত্ব। এই মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন- জন লক, জেরিমি বেন্থাম, টি এইচ গ্রীণ, ম্যাকাইভার, জন রলস,
রবার্ট নোজিক প্রমুখ।
মূল বক্তব্যঃ
উদারনীতিবাদ বা Liberalism শব্দটি এসেছে
ল্যাটিন শব্দ ‘Liber’ থেকে যার অর্থ হল স্বাধীন। অর্থাৎ
শব্দগত অর্থে উদারনীতিবাদ হল স্বাধীনতার মতবাদ। সাধারণভাবে
বলা যায়, উদারনীতিবাদ হল সেই মতবাদ যা
ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং রাষ্ট্রের
কার্যাবলিকে সীমিত করতে চায়।
উদ্ভব ও বিকাশঃ
সামন্তযুগের
শেষ পর্বে ষোড়শ শতাব্দীতে ক্ষমতাবান অভিজাত ও যাজক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
হিসাবে উদারনৈতিক তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করে। ক্রমে এই মতবাদ বুর্জোয়া
রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার হাতিয়ারে পরিণত হয়। উদারনীতিবাদের এই
পরিবর্তনের ধারাকে লক্ষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই মতবাদকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন।
যথা-
i) সনাতন উদারনীতিবানঃ
সনাতন উদারনীতিবাদীরা
ছিলেন ধনতন্ত্রের বিকাশের প্রথমদিকের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। এঁরা ছিলেন
ব্যক্তি-স্বাধীনতার পূজারী। এঁরা রাষ্ট্রকে দেখেছেন ব্যক্তি-স্বাধীনতার রক্ষক
হিসাবে। এঁদের মতে ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়। সনাতন উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলেন- জন লক, জেরিমি বেন্থাম, অ্যাডাম স্মিথ,
জেমস্ মিল, প্রমুখ।
ii) সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদঃ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের
দিকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রভাবে ইউরোপীয় দেশগুলিতে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট
বেড়ে যায়, মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণির হাতে
সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে, সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ, অসন্তোষ জমা হতে থাকে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ সনাতন উদারনীতিবাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে, সনাতন
উদারনীতিবাদের নেতিবাচক রাষ্ট্রের ধারণাকে সংশোধন করে যে উদারনীতিবাদকে জনসাধারণের
কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয় তাই হল সংশোধিত উদারনীতিবাদ। সংশোধন মূলক
উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন- টি. এইচ. গ্রিন, ম্যাকাইভার, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ।
iii) নয়া-উদারনীতিবাদঃ
নয়া-উদারনীতিবাদ
সনাতন উদারনীতিবাদের মতো রাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
নয়া-উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিধিকে সীমিত করতে চায় এবং রাষ্ট্রীয়
উদ্যোগের অবসান ঘটিয়ে অর্থনীতির পুরোপুরি বেসরকারিকরণ ঘটাতে চায়। নয়া
উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন- জন রলস, রবার্ট নোজিক, ফ্রেডারিক
হায়েক, মিল্টন ফ্রিডম্যান প্রমুখ।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
উদারনৈতিক
রাষ্ট্র তত্ত্বের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের
পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায়। যেমন-
i) ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষাঃ
সনাতন উদারনীতিবাদীরা ছিলেন ধনতন্ত্রের বিকাশের প্রথমদিকের
রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। এঁরা ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীনতার পূজারি। এঁরা রাষ্ট্রকে দেখেছেন
ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে। এঁদের মতে, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়।
এঁরা রাষ্ট্রকে এক চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছোবার উপায় বলে মনে করেন।
ii) নেতিবাচক রাষ্ট্রের ধারণাঃ
সনাতন উদারনীতিবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রের কার্যাবলি
সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা। জেরেমি বেথাম, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ সনাতন উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব
দিয়ে রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে সীমিত করার পক্ষপাতী ছিলেন।
iii) রাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাঃ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রভাবে ইউরোপীয়
দেশগুলিতে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি পায়। মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণির হাতে
সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে। এই অবস্থায় উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ নেতিবাচক
রাষ্ট্রের ধারণার পরিবর্তে ইতিবাচক রাষ্ট্রের ধারণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
iv) নৈতিক দৃষ্টিকোণঃ
জন স্টুয়ার্ট
মিলের মতে, রাষ্ট্র
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যেমন—সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা, সম্পত্তির
উত্তরাধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ,
কাজের সময়সীমা নির্ধারণ ইত্যাদি। তবে রাষ্ট্র কখনোই মানুষের
আত্মকেন্দ্রিক কার্যাবলির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে না।
v) সীমিত রাষ্ট্রের ধারনাঃ
নয়া-উদারনীতিবাদীরা
রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সীমিত করার কথা বলে। তবে তারা রাষ্ট্রের পুরোপুরি বিলোপ চাননা।
ধ্রুপদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতোই তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্র
অশুভ হলেও প্রয়োজনীয়।
সমালোচনাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার
ইতিহাসে উদারনৈতিক তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও এর
সমালোচনাও কোনো অংশে কম নয়। নীচে উদারনীতিবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-
i) বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ রক্ষাঃ
সনাতন উদারনীতিবাদীরা যে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অবাধ অর্থনীতির কথা বলেন, তা ছিল উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থের অনুকূল।
সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানুষে মানুষে অসাম্য-বৈষম্য,
মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ-নির্যাতন- এসব নিয়ে সনাতন
উদারনীতিবাদীদের কোনো চিন্তা ছিলনা।
ii) রাষ্ট্রের নেতিবাচক ধারণাঃ
সনাতন উদারনীতিবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রের কার্যাবলি
সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রদান। জেরেমি বেথাম, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ সনাতন উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব
দিয়ে রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে সীমিত করার পক্ষপাতী ছিলেন।
iii) মার্কসীয় সমালোচনাঃ
মার্কসবাদীদের মতে
উদারনীতিবাদ যে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলেছেন তা আসলে পুঁজিপতি শ্রেণীর
স্বার্থ রক্ষার নতুন কৌশল। মার্কসবাদীদের মতে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হল একচেটিয়া
পুঁজিবাদের কার্যনির্বাহ কমিটি। পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সংকটের সময় মুমূর্ষু
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে আধুনিককালের উদারনীতিবিদরা জন-
কল্যানকর রাষ্ট্রতত্ত্বের কথা বলেছেন।
iv) পরস্পর বিরোধী ধারনাঃ
উদারনীতিক
বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধারণাও বর্তমান। এই মতবাদে একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়
কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা উভয়কেই স্বীকার করা হয়েছে। তেমনি আবার উদারনীতিক
দর্শন আদর্শবাদ ও ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদ উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছে। অথচ
আদর্শবাদী ও ব্যক্তিস্বাতস্থ্যবাদী দর্শন পরস্পর-বিরোধী।
v) রক্ষণশীল মতবাদঃ
এই মতবাদকে চরম রক্ষণশীল মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ধনতন্ত্রের
রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে সপ্তদশ শতকে যে উদারনীতিবাদের আবির্ভাব ঘটে, আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে এসে তাই নয়া-উদারনীতিবাদ
নামে পরিচিত। বিশ্বায়নের নতুন প্রেক্ষাপটে নয়া-উদারনীতিবাদীরা বিভিন্ন তত্ত্বের
মাধ্যমে আসলে ধনতন্ত্রকেই সুরক্ষিত রাখতে চান।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে উদারনৈতিক রাষ্ট্র তত্ত্বের গুরুত্বকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায়না। কারন ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিকাশ ও বিস্তারের ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের অবদান অনস্বীকার্য।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)
৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)
৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)
৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)
তৃতীয় অধ্যায়
১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৩) নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)
৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)
৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)
৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ