প্রশ্ন-১; রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
উত্তরঃ
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রের
উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিষয়ে যতগুলি মতবাদ প্রচলিত আছে, সেগুলির মধ্যে আদর্শবাদ বা ভাববাদ হল এক সুপ্রাচীন মতবাদ।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের চিন্তায় এই মতবাদের প্রকাশ ঘটে।
পরবর্তীকালে কান্ট, হেগেল, গ্রিন,
ব্রাডলে, বোসাংকে প্রমুখ চিন্তাবিদ এই মতবাদের
বিকাশে সহায়তা করেন।
মূল বক্তব্যঃ
ভাববাদ অনুযায়ী
পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু হল একটি নির্দিষ্ট ভাবের বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটিও মানুষের ভাবের
বহিঃপ্রকাশ মাত্র। রাষ্ট্র হল মানবসমাজের নৈতিক আদর্শ বা মহৎ ভাবের জীবন্ত প্রতীক। রাষ্ট্রের সমস্ত আদেশ ন্যায় ও সত্যের ওপর
প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্র মানুষের স্বাভাবিক, অপরিহার্য ও চূড়ান্ত একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তির
পক্ষে পরিপূর্ণ বিকাশ ও নিজেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্য দিয়েই ব্যক্তির চরম বিকাশ ঘটতে পারে। রাষ্ট্র
হল ব্যক্তিস্বাধীনতার উৎস ও সংরক্ষক।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
ভাববাদ
বা আদর্শবাদের উপরিউক্ত ব্যখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি
বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায়। যেমন-
i) রাষ্ট্র সর্বচ্চ ও অভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানঃ
ভাববাদ বা আদর্শবাদ
রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক, প্রয়োজনীয় এবং
চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে। হেগেলের মতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা
অসীম, চরম এবং সর্বব্যাপী। অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র হল সমাজের সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান।
ii) রাষ্ট্রের ঊপর দেবত্ব আরোপঃ
ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তারা রাষ্ট্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন।
রাষ্ট্র হল আধ্যাত্মিক যুক্তির প্রতীক ও প্রকাশ। এ হল এক স্বর্গীয় সংগঠন।
পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপলব্ধি রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্ভব। কান্ট ও হেগেল এই দুই জার্মান
দার্শনিকের মতানুসারে রাষ্ট্র হল পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদক্ষেপ।
iii) রাষ্ট্র অধিকার ও স্বাধীনতার উৎসঃ
ভাববাদীদের মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা সহ সবকিছু ভালোর
উৎস। কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই ব্যাক্তির স্বাধীনতা ভোগ সম্ভব। রাষ্ট্রের প্রতি চরম
আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। হেগেলের মতানুসারে
ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যে স্বাধীনতা ভোগ করে সেটাই
হল যথার্থ বা প্রকৃত স্বাধীনতা।
iv) রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্নঃ
ভাববাদ বা আদর্শবাদ
অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজ হল এক ও অভিন্ন। এই মতবাদ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কোনো রকম
পার্থক্যকে স্বীকার করেননি।
v) রাষ্ট্র সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতীকঃ
ভাববাদীদের মতে
রাষ্ট্র হল সমষ্টিগত ইচ্ছা বা সাধারণ ইচ্ছার সমষ্টি। হেগেলের মতে রাষ্ট্র হল
সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতীক। সমষ্টিগত ইচ্ছা বা সাধারণ ইচ্ছা হল প্রত্যেকের প্রকৃত
ইচ্ছার সর্বোৎকৃষ্ট সমন্বয়। সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে সার্বজনীন কল্যাণ নিহিত আছে।
এই ইচ্ছা হল সার্বজনীন কল্যাণের প্রতীক।
সমালোচনাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার
ইতিহাসে ভাববাদ বা আদর্শবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও এর
সমালোচনাও কোনো অংশে কম নেই। নীচে ভাববাদ বা আদর্শবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা
হল-
i) রাষ্ট্র সর্বচ্চ প্রতিষ্ঠান নয়ঃ
সমালোচকদের মতে ভাববাদ
রাষ্ট্রকে স্বাভাবিক, প্রয়োজনীয় এবং
চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে, ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারী শাসন
ব্যবস্থার ইন্ধন জুগিয়েছেন। এছাড়া মার্কসবাদীদের মতে, রাষ্ট্র
শাশ্বতও নয়, আবার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানও নয়। তাঁদের মতে
রাষ্ট্র একটি শোষণের যন্ত্র। সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে রাষ্ট্রের
উৎপত্তি হয়েছে এবং শোষণের অবসানে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটাবে।
ii) অবাস্তব ধারণাঃ
সমালোচকদের মতে ভাববাদ বা আদর্শবাদ হল একটি অবাস্তব মতবাদ। এই মতবাদে
বাস্তব উপাদানকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রকে বাস্তবতাবর্জিত আদর্শের দৃষ্টিতে দেখা হয়।
ভাববাদী তত্ত্বে যে রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে তা বিমূর্ত ও অধিবিদ্যক। বার্কার এর
মতে, “ভাববাদে যে রাষ্ট্রের কল্পনা করা হয় তা
স্বর্গরাজ্যে সম্ভব হতে পারে, মাটির পৃথিবীতে তা প্রতিষ্ঠিত
হয়নি।”
iii) রাষ্ট্র ও সমাজ এক নয়ঃ
ভাববাদ বা আদর্শবাদের রাষ্ট্র ও সমাজের
অভিন্ন ধারণা ঠিক নয়। কারন রাষ্ট্র ও সমাজ এক নয়। সমাজ অপেক্ষা রাষ্ট্র অনেক বেশী ব্যাপক এবং এর কাজকর্মের পরিধিও অনেক বেশি। সমস্ত সামাজিক
প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রাষ্ট্র হল অন্যতম প্রতিষ্ঠান।
iv) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধীঃ
ভাববাদ বা আদর্শবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের
পরিপন্থী। এই মতবাদে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কাছে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বলি দেওয়া
হয়েছে। ভাববাদে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের হাতে ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছে। তার ফলে
রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
v) অগণতান্ত্রিক ধারনাঃ
সমালোচকদের মতে ভাববাদ বা আদর্শবাদ একটি অগণতান্ত্রিক
ধারনা। এখানে রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত ইচ্ছার সমষ্টি বলে
বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে সকলের ইচ্ছা নাও থাকতে পারে।
অর্থাৎ এই মতবাদে সমষ্টিগত ইচ্ছা বা প্রকৃত
ইচ্ছার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকেই ব্যক্তির উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মূল্যায়নঃ
উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ভাববাদ বা আদর্শবাদের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারন রাষ্ট্রের প্রতি ব্যাক্তির আনুগত্যের বিষয়টিকে কখনো উপেক্ষা করা যায়না।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)
৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)
৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)
৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)
তৃতীয় অধ্যায়
১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৩) নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)
৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)
৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)
৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ