প্রশ্ন-১; রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
উত্তরঃ
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত যতগুলো
তত্ত্ব প্রচলিত আছে তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব হল গান্ধীবাদ। মহাত্মা গান্ধী
স্বয়ং এই তত্ত্বের অবতারণা করে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হিন্দ স্বরাজ নামক
গ্রন্থে মহাত্মা গান্ধির রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
মূল বক্তব্যঃ
গান্ধিজীর মতে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি হল হিংসা এবং
বলপ্রয়োগ। রাষ্ট্র হল এমন একটি প্রাণহীন যন্ত্র যা সহিংস বলপ্রয়োগ ছাড়া বাঁচতে
পারে না। আধুনিক শক্তিধর রাষ্ট্রকে তিনি ভয়ের চোখে দেখেছেন। তাঁর মতে,
এই রাষ্ট্রে মানুষের ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে এবং মানব সমাজের
সমূহ সর্বনাশ হয়। রাষ্ট্র মানুষের সার্বিক বিকাশের পরিপন্থী। এই সকল কারণে
গান্ধিজি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার তীব্র বিরোধী ছিলেন। গান্ধিজি রাষ্ট্রকে 'নিজেই নিজের লক্ষ্য' বলে মনে না করে
লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায় বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রকে কোনো পবিত্র প্রতিষ্ঠান বলে মনে
করার কারণ নেই। মানুষের দুর্বলতার জন্যই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়েছে।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
গান্ধিজীর রাষ্ট্র
তত্ত্বের উপরিউক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা
বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-
i) কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সংগঠনঃ
রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে গান্ধিজী বলেছেন যে, বলপ্রয়োগই হল আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। হিংসা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব বজায় রাখে।
তাঁর মতে, রাষ্ট্র হল কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সংগঠন। সুতরাং, রাষ্ট্র ক্ষমতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের বিনাশ করে।
রাষ্ট্র মানুষের সার্বিক বিকাশের পরিপন্থী।
ii) সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রক্ষমতাঃ
গান্ধিজী প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রের
প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি। তিনি রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধিকে
সীমাবন্ধ করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের পরিবর্তে স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে
অধিকাংশ দায়িত্ব অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। এদিক থেকে গান্ধিবাদ
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এবং সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রের পক্ষপাতী। তাঁর মতে, সেই রাষ্ট্র ভালো, যা
সর্বাপেক্ষা কম শাসন করে।
iii) রাষ্ট্রের লক্ষ্য জনকল্যাণঃ
গান্ধিজীর মতে, রাষ্ট্রের
প্রধান লক্ষ্য হল জনগণের কল্যাণ, রাষ্ট্র হল সমাজের সকলের
কল্যাণসাধনের উপায়মাত্র। রাষ্ট্র এই উদ্দেশ্যসাধনে ব্যর্থ হলে অথবা ক্ষমতার
অপপ্রয়োগ ঘটলে ব্যক্তি সত্য
ও অহিংসার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে।
iv) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও পঞ্চায়েতিরাজঃ
গান্ধিজীর রাষ্ট্র-পরিকল্পনার লক্ষ্য হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বায়ত্তশাসন
অর্জন। গান্ধিজি মনে করেন যে, রাষ্ট্রের
মধ্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হবে এবং পশ্চায়েতিরাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। পঞ্চায়েত এবং
স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানগুলি দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবে।
v) সর্বোদয় এবং রামরাজ্যঃ
এক আদর্শ রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করতে গিয়ে গান্ধিজী রাষ্ট্রবিহীন এবং
শ্রেণিবিহীন সমাজের কথা উল্লেখ করেন। গান্ধিজির মতে, এই সমাজ হবে সাম্যভিত্তিক। প্রতিটি মানুষ শ্রম ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে
সামগ্রিক কল্যাণে উদ্গ্রীব হবে। প্রতিটি ব্যক্তির কর্মের মর্যাদা এক হবে। সমস্ত জাতি
ও শ্রেণির সার্বিক বিকাশ ঘটবে। এই কাল্পনিক অবস্থাকে তিনি সর্বদয় হিসাবে চিহ্নিত
করেছেন। সর্বদয়ের অর্থ হল- সবার উন্নয়ন। এই রাষ্ট্রবিহীন সমাজ বা গণতন্ত্রকে তিনি 'রামরাজ্য' বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
সমালোচনাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার
ইতিহাসে গান্ধিজির রাষ্ট্রতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও এর সমালোচনাও
কোনো অংশে কম নেই। নীচে গান্ধিজির রাষ্ট্র তত্ত্বের সমালোচনাগুলি আলোচনা করা হল-
i) অস্পষ্ট ধারণাঃ
গান্ধিজির
রাষ্ট্র তত্ত্ব যথেষ্ঠ অস্পষ্ট। তিনি বিভিন্ন দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার
সমালোচনা করলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোনো স্পষ্ট তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে
পারেননি। তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও তাঁর পুরোপুরি অবলুপ্তি চাননি।
আবার রাষ্ট্রের দ্বারা জন কল্যানের কথা বললেও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে যতটা সম্ভব সীমিত
করার কথা বলেছেন।
ii) অসম্পুর্ণ ধারণাঃ
সমালোচকদের
মতে গান্ধিজি একটি অসম্পুর্ণ রাষ্ট্র তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। কারন তাঁর রাষ্ট্র
তত্ত্বে রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ , রাষ্ট্রের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য প্রভূতি সম্পর্কিত
বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে।
iii) স্ব-বিরোধীতাঃ
গান্ধিজির
রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে স্ববিরোধীতার অস্তিত্ব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তিনি
রাষ্ট্রবিহীন সমাজের কথা বললেও রাষ্ট্রের সম্পুর্ণ অবিলুপ্তিকে আবার সমর্থন
করেননি।তিনি রাষ্ট্রের হাতে যত কম সম্ভব ক্ষমতা অর্পনের কথা বলেছেন।
iv) ধর্ম ও নীতি-নৈতিকতার প্রভাবঃ
গান্ধিজির
রাষ্ট্র তত্ত্বে ধর্ম ও নীতি-নৈতিকতার অবিসংবাদিত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি
বাস্তবের পরিবর্তে কল্পনার সাহায্যে এক আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন যেখানে কোনো
প্রকার শোষণ-পীড়ন থাকবেনা। তিনি যে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তা
সম্পুর্ণভাবে আধ্যাত্মিক ও বাস্তবতাবর্জিত।
iv) জাতীয়তাবাদী আন্দোলনঃ
গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাধারায় রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ধারণা উপেক্ষিত হয়েছে।
তিনি রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক আলোচনার পরিবর্তে ব্রিটিশ শসনাধীন ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক
শাসন শোষণ এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সামনে রেখে তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত
চিন্তাধারার কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।
মূল্যায়নঃ
গান্ধিজির রাষ্ট্র তত্ত্বের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হলেও এর গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। নৈতিকতা ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়সাধন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান—এই দিকগুলি ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনে মহাত্মা গান্ধির মৌলিক অবদান।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)
৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)
৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)
৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)
তৃতীয় অধ্যায়
১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৩) নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)
৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)
৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)
৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ