প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তা
প্রশ্ন; প্রাচীন গ্রীক
রাষ্ট্রচিন্তার মূল বৈশিষ্ট আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
উত্তরঃ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
রাষ্ট্রচিন্তার সূত্রপাত সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তা বলতে যা বোঝায় তার সূচনা হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসেই। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-
১) যুক্তিবাদের
প্রাধান্যঃ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দার্শনিকদের যুক্তিবাদিতা। গ্রিক চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করতেন যে, জীবন ও জগৎ যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজের প্রতিটি ঘটনাকে মানুষ যুক্তি দিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সফিস্ট দার্শনিকরা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
২) নগর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাঃ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্য একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা। নগর-রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছিল। রাষ্ট্র বলতে গ্রিক দার্শনিকরা মূলত নগর-রাষ্ট্রকেই বোঝাতেন।
৩) ন্যায়বিচারঃ
ন্যায়বিচার সম্পর্কে এক সর্বজনীন সূত্র আবিষ্কারের প্রচেষ্টা ছিল
গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ন্যায়বিচার হল সমগ্র গ্রিক
সমাজব্যবস্থার প্রকৃত চালিকাশক্তি। গ্রিকরা সমাজকে এমনভাবে পরিচালিত করতেন যাতে সমাজের সকল স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হত। ন্যায়বিচারের বাস্তবায়ন ও
সংরক্ষণের জন্য গ্রীকরা নানাপ্রকার আইন প্রণয়ন করতেন।
৪) শ্রেণিভিত্তিক সমাজঃ
গ্রিক
রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শ্রেণীভিত্তিক সমাজের ধারণা প্রদান। গ্রিক
চিন্তাবিদরাই প্রথম দেখিয়েছেন— শ্রেণিগত অবস্থানের ওপর রাষ্ট্রের রূপ নির্ধারিত
হয় এবং অর্থনৈতিক স্বার্থই শ্রেণিচরিত্র নির্ধারণ করে। প্লেটো সমাজের স্থিতাবস্থা
রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। অ্যারিস্টটল ক্রীতদাস প্রথার সংরক্ষণে সোচ্চার হয়েছিলেন।
৫) রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারনাঃ
গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনে
রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গন্য করা হয়েছে। তাদের মতে রাষ্ট্র
কোনো চুক্তির ফল নয় বা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ঠ কোনো প্রতিষ্ঠানও নয়।
প্লেটো-অ্যারিস্টটলের মতে, অন্যান্য স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানের মতো রাষ্ট্রও
স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিকদের কাছে রাষ্ট্র শুধু স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানই
নয়, অন্য যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় রাষ্ট্র হচ্ছে
সর্বোৎকৃষ্ট।
৬) আইন সম্পর্কিত ধারণাঃ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় আইনের উৎস ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনাও স্থান পেয়েছে। গ্রিকরা মনে করতেন রাষ্ট্র নয়, প্রকৃতিই হল আইনের উৎস। রাষ্ট্রের কাজ আইনকে প্রয়োগ করা, সৃষ্টি করা নয়। তবে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রিকদের ধারণা বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। হোমার ও হেসিয়ডের সাহিত্যে আইনকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল এবং আইনকে প্রথা ও ঐতিহ্যের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাজতন্ত্রের জায়গায় যখন অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল, তখন আইনের নৈতিক ও ধর্মীয় ধারণাটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং লিখিত আইনের গুরুত্ব বাড়তে থাকল।
৭) তাত্ত্বিকরনের সুত্রপাতঃ
প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্র দার্শনিকগণ রাজনীতি শাস্ত্রের তাত্ত্বিকরনের
সুত্রপাত করেছিলেন। গ্রীক পণ্ডিতগণ রাজনীতি শাস্ত্রের যে মূলসূত্রগুলি আবিস্কার
করেছিলেন সেগুলিকে রাজনীতিক তত্ত্বের গোড়ার কথা হিসেবে বা রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে
গণ্য করা যায়। যেমন গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের
উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি
বিষয়ে তাদের ধারণা ও মন্তব্য আজও গুরুত্বপূর্ণ্য।
৮) মানবিকতাবোধঃ
গ্রিক
দার্শনিকরা মানবতাবাদী ছিলেন। মানুষই ছিল গ্রিকদের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্র। হোমার
ও হেসিয়ডের কাব্যের মূল বিষয় ছিল মানুষ। মানুষের কী হওয়া উচিত এবং কী অনুসরণ
করা উচিত—এই নিয়ে সক্রেটিস অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। সোফোক্লিস এর মতে, অন্যান্য
জাতি- ঈশ্বর, রাজা, পরমাত্মার ওপর প্রাধান্য দিয়েছিল, কিন্তু গ্রিকরা
কেবল প্রাধান্য দিয়েছিল মানুষকে।
৯) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের একাত্মতাঃ
গ্রিক
রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন বিরোধ ছিলনা। ব্যক্তির নৈতিক
উন্নতি ও রাষ্ট্রের নৈতিক উন্নতির মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতোনা । রাষ্ট্রসত্তার
মধ্যেই ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণতা। ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র বলে কোন কথা তারা কল্পনাও
করতে পারতেন না। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করাকে গ্রিকগণ এক উন্নততর সত্তার
প্রতি আনুগত্য পোষন বলে মনে করতেন।
১০) স্বয়ংসম্পূর্ণতাঃ
গ্রিক নগররাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হল সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই ওই নগর রাষ্ট্রের আওতাধীন ছিল। এ কারণেই অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্র কতগুলো পরিবার ও জনপদের এমন একটি সমন্বয় যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুখী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলা।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর সমস্ত নোটস
(বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সহ)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
৩) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৪) প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ করো। ১০ (২০২২)
২) প্লেটো কীভাবে ন্যায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন? ৫(২০১৯)
0 মন্তব্যসমূহ