মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি

Ad Code

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি

 


প্রশ্ন-১; রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
উত্তরঃ 

ভূমিকাঃ

        রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যতগুলো দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে তারমধ্যে অন্যতম হল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমূখ।

মূল বক্তব্যঃ

        রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি মূলত রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল বক্তব্য হল, সমাজজীবনের শুরু থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি বা আকস্মিকভাবেও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। সমাজের অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে সমাজ যখন বিত্তবান এবং বিত্তহীন এই দুই পরস্পর-বিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন থেকেই শুরু হল এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব, এক শ্রেণির দ্বারা অপর শ্রেণিকে শোষণ এবং সেই শোষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ও শোষণকে অব্যাহত রাখার জন্য রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটল।

প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির উপরিউক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করা যায়। যেমন-

i) রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্র সমাজ বহির্ভূত কোনো আরোপিত সংগঠন নয়। সমাজ বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এঙ্গেলস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, অনন্তকাল ধরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলনা। অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে সমাজে শ্রেণিবিভাগের ফলে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়।

ii) রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের যন্ত্রঃ

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার। বিভিন্ন যুগে রাষ্ট্র সমাজের মেহনতী মানুষদের শোষণ করে প্রভাবশালী শ্রেনীর স্বার্থে কাজ করেছে। যেমন দাস সমাজে দাসদের স্বার্থে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্ত প্রভূদের স্বার্থে এবং বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্র কাজ করেছে।

iii) রাষ্ট্রের অবলুপ্তিঃ

        মার্কসীয় রাষ্ট্র দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্রের অবলুপ্তি অনিবার্য। মার্কসবাদীদের মতে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হল সমস্ত রকম শ্রেণি শোষণের অবসান এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করা।  এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশের ফলে সর্বপ্রকার শোষণের অবসান ঘটবে এবং সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাম্যবাদী সমাজে শোষণ না থাকায় শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রেরও অবলুপ্তি ঘটবে।

iv) শ্রেণীহীন সমাজঃ

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। এই শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব অনিবার্য। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মূলত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

v) অর্থনীতির প্রাধান্যঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থনীতির অবিসংবাদিত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসবাদ মূলত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব, বিকাশ, প্রকৃতি প্রভূতি ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করেছন।

সমালোচনাঃ

        রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও এর সমালোচনাও কোনো অংশে কম নেই। নীচে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনাগুলি আলোচনা করা হল-

i) সর্বজনগ্রাহ্য নয়ঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলে মনে করা হলেও এটি কোনো সর্বজনগ্রাহ্য দৃষ্টিভঙ্গি বলে স্বীকৃতি পায়নি। মার্কসবাদীদের মতে, সমাজ ব্যবস্থার বিকাশের এক বিশেষ স্তরে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। কিন্তু সব জায়গায় সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ একইভাবে হয়নি।

ii) রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের যন্ত্র নয়ঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রেণী শোষনের যন্ত্র হিসাবে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র শ্রেণী শোষনের যন্ত্র নয়। কারন বর্তমান প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক চরিত্র দেখা যায়। তাছাড়া শোষনের পরিবর্তে শ্রেণী সহযোগিতাও কোনো অংশে কম নেই।

iii)  রাষ্ট্রের অবলুপ্তি হয়নিঃ

        রাষ্ট্রের অবলুপ্তি সংক্রান্ত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। কারন বর্তমানে রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও অবলুপ্তির পরিবর্তে আর বেশি অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

iv) শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নিঃ

        মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির মত শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারনাও ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিপ্লবের পর শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও কার্যত এখনো তা হয়ে ওঠেনি। বরং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমাজ বিপ্লবের পর এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী শাসক শ্রেণি গড়ে ওঠেছে।

v) অর্থনীতির নিয়ন্ত্রনবাদঃ

          সমালোচকরা মার্কসীয়  দৃষ্টিভঙ্গিকে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রনবাদ বলে সমালোচনা করেছেন। মার্কসবাদ মূলত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব, বিকাশ, প্রকৃতি প্রভূতি ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করেছন। অর্থনীতি ছাড়াও অন্যান্যও বিষয়ও যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে মার্কসবাদ তা মনে করেনি।

মূল্যায়নঃ

        উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারন রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সংক্রান্ত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ঠ বিজ্ঞান ভিত্তিক। 


লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রথম অধ্যায়

১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)


৪) রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)


৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)


৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।


৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)


৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)


১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। একত্ববাদী তত্ত্বের মূখ্য প্রবক্তা কারা? ১০ (২০১৯), ১০ (২০২২)


৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)

তৃতীয় অধ্যায়

১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।


২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)


৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

চতুর্থ অধ্যায়

১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।


২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


৩)  নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)


৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)

পঞ্চম অধ্যায়

১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)


২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)


৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)


৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)


৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

Main Menu


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code