রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা
ভূমিকা;
রবীন্দ্রনাথের রাজনীতিক চিন্তাধারার প্রধান ভিত্তি ছিল সমাজতন্ত্র ও দর্শন। সমস্থ কিছুই তিনি সমাজতান্ত্রিক ও দার্শনিক ভিত্তিতে এবং আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের প্রেক্ষাপটে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তার সমগ্র আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক, সংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ও রচিত হয়েছিল।
রাষ্ট্র কি;
রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় সমাজ শক্তির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। তিনি
বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের মধ্যেই ভারতের কল্যান শক্তি নিহিত আছে। এদেশের স্বাধীনতা
সমাজের সমাজের স্বাধীনতার মধ্যেই বর্তমান।এই কারনে রবীন্দ্রনাথ সমাজকে সংগঠিত করার
কথা বলেছেন এবং এই উদ্দেশ্যে সমাজের মধ্যে কতৃশক্তি গরে তোলা দরকার। এই কতৃশক্তিই
হল রাষ্ট্র। রবীন্দ্রনাথ রচিত সমাজ, স্বদেশী সমাজ, ভারতবর্ষীয় সমাজ এবং কালান্তর
পর্যায়ের বিভিন্ন প্রবন্ধে তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনার সন্ধান পাওয়া যায়।
ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি;
পশ্চিমি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি হল জাগতিক প্রবৃত্তির
পরিতৃপ্তি সাধন। এই কারনে ইউরোপের ইতিহাস হল রাষ্ট্র শক্তির ইতিহাস। রাষ্ট্রিয়
ক্ষমতা একচ্ছত্র হয়ে পড়লে রষ্ট্রিয় অপশাসনের আশঙ্কা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
মতে ভারতবর্ষে এরকম ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শন প্রাসঙ্গিক নয়। কারন ভারতের মানুষ কখনোই
প্রবৃত্তির দাস ছিলোনা। বরাবরই আত্মশক্তিতে বলিয়ান। প্রবৃত্তি নয় নিবৃত্তির পদকেই
ভারতবাসি আকড়ে ধরে আছে। এই কারনে আত্মশক্তি হল ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি।
রাষ্ট্র ও সমাজ;
রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সমাজ, স্বদেশী সমাজ, ভারতবর্ষীয়
সমাজ, এবং কালান্তর পর্যায়ের বিভিন্ন প্রবন্ধে যে রাষ্ট্র ভাবনার সন্ধান পাওয়া যায়
তাতে সমাজ শিক্তিরেই প্রাধান্য দেখা যায়। তারমতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান
বনিয়াদ বা ভিত্তি হল সমাজ। এই সভ্যতা সংস্কৃতি বা সমাজকে সুসংগঠিত করার জন্যই
রাষ্ট্রের দরকার।
কালান্তর
পর্যায়ের রবীন্দ্রনাথের রাজনীতিক মত শীর্ষক রচনায় তিনি বলেছিলেন, “চিরদিন
ভারতবর্ষে এবং চীন দেশে সমাজতন্ত্রই প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নীচে। দেশ
যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে । সমাজেই বিদ্যার
ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন, অপরাধিকে দন্ড প্রভূতি।
রাষ্ট্র
প্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বন্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান। সমাজপ্রধান
দেশে প্রাণ সর্বত্র ব্যপ্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র প্রধান দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রের পতনে
দেশের পতন ঘটে। এইভাবে প্রাচীন গ্রিস ও রোমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। কিন্তু
চীন বা ভারত সুদীর্ঘ রাষ্ট্রিয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
কারন সর্বব্যাপি সমাজে তার আত্মা প্রসারিত।
রবীন্দ্রনাথের
মতে কেবলমাত্র বৃহত্তর সমাজেই মানুষের সমষ্টি চেতনার বাস্তবায়ন সম্ভব। মানুষের
সমষ্টিগত যাবতীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর সমাজের গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের
উর্দ্ধে। এই কারনে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার থেকে বৃহত্তর
সমাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অধিক।
মূল্যায়ন;
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ তার ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র আলোচনায় সমাজের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাষ্ট্রকে তেমন কোনো প্রাধান্য দেননি। তিনি রাষ্ট্রতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের ওপর অধিক জোড় দিয়েছেন। তারমতে আত্মশক্তি ও সমাজ শক্তিই হল ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি বা বনিয়াদ।
লেখকজগন্নাথ বর্মন {M.A.(JU) M.Phil.(RGU)}সহকারী অধ্যাপকসিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই পেপারের ওপর অন্যান্য নোটস
0 মন্তব্যসমূহ