আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি; Behavioral Approach

Ad Code

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি; Behavioral Approach

 


প্রশ্ন; রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)

ভূমিকাঃ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যতগুলি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মধ্যে চার্লস মেরিয়াম, ডেভিড ট্রুম্যান,  হার্বাট সাইমন, ডেভিড ইস্টন, রবার্ট ডাল, গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞাঃ

সাধারনভবে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে,  রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা-পর্যালোচনা পরিবর্তে মানুষের রাজনৈতিক আচরণ,  আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতা ,সংখ্যায়ন, প্রকৃতিক বিজ্ঞান সমূহের অভিজ্ঞতা প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ডেভিড ইস্টন আচরণবাদকে একটি বৌদ্ধিক প্রবণতা ও নির্দিষ্ট বিদ্যাবিষয়ক আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। রবার্ট ডাল এর মতে, আচরণবাদ হল এক আন্দোলন ও পদ্ধতি যা ঐতিহাসিক দার্শনিক ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যবেক্ষণশীল আচরণের মাধ্যমে রাজনীতির ব্যাখ্যায় সচেষ্ট।

প্রকৃতির বা বৈশিষ্ট্যঃ

আচরণবাদের উপরিউক্ত সজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আচরণবাদের নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-

i) মূল্য নিরপেক্ষ আলোচনায়ঃ  

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা রাজনীতির আলোচনাকে মূল্য-নিরপেক্ষ করে তোলার পক্ষপাতী। যে কোন বৈজ্ঞানিক আলোচনার অন্যতম শর্ত হলো মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা, এই কারণে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা থেকে মূল্যবোধকে বাতিল করার পক্ষপাতি।

ii) বিজ্ঞানসম্মত পদ্মতি অনুসরণঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সমাজ বিজ্ঞানের পন্থা-পদ্ধতি অনুসরণ করার ওপর জোর দেয়। যেমন- তথ্য সংগ্রহ, বিচার-বিশ্লেষণ, তত্ত্বের যথার্থতা যাচাই প্রভূতি।

iii) ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণ ব্যাখ্যাঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ব্যক্তির আচার-আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তাধারা প্রভূতির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ রাজনীতির আচরণগত প্রকৃতি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

iv) আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতাঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞান সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাই আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞান সহযোগিতার ওপর সামাজিক বিজ্ঞানগুলির সাফল্য ও সার্থকতা নির্ভরশীল।

v) বাস্তবতা বর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যনিরপেক্ষতা তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুশ্রুত হওয়ায় প্রাপ্ত ফলাফল বা সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তব উপযোগিতার ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনো চিন্তা করে না। অর্থাৎ এই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল বাস্তবতা বর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি।  

সমালোচনাঃ

বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আচরণবাদের আবির্ভাব ঘটলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। নানা দিক থেকে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা প্রকট হতে থাকে। যেমন-

i) মূল্যবোধকে অস্বীকারঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক আলোচনায় ভালো-মন্দ উচিত-অনুচিত ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে রাজনৈতিক আলোচনাকে মূল্য নিরপেক্ষ করে তোলার পক্ষপাতী। কিন্তু মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অসম্ভব।

ii) বিজ্ঞানসম্মত নয়ঃ

আচরণবাদ রাজনৈতিক বিজ্ঞানের আলোচনায় বা পর্যালোচনায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী। এক্ষেত্রে আচরণবাদীরা প্রকৃতিক বিজ্ঞানের কলা-কৌশল অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু প্রকৃতিক বিজ্ঞানের এইসব কলা-কৌশল প্রয়োগ করেও আচরণবাদীরা একে যথার্থ বিজ্ঞান শাস্ত্রে পরিণত করতে পারেনি।

iii) মানব সমাজের সামগ্রিক সত্ত্বাকে উপেক্ষাঃ

আচরণবাদীরা রাজনৈতিক ঘটনা, রাজনৈতিক কাঠামো,  রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভূতির পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণের প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানব সমাজ সম্পর্কে সাধারণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ মানব সমাজের একটি সামগ্রিকতা আছে।

iv) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বিপন্নঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পরিসংখ্যান তত্ত্ব, মনোবিদ্যা, অঙ্ক শাস্ত্র প্রভূতির সাহায্য গ্রহণের কথা বলেন। সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রতি নির্ভরতার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলেছে।

v) বাস্তবতা বর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিঃ

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যনিরপেক্ষতা তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুশ্রুত হওয়ায় প্রাপ্ত ফলাফল বা সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তব উপযোগিতার ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনো চিন্তা করে না। অর্থাৎ এই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল বাস্তবতা বর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি।  

মূল্যায়নঃ

উপরিউক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না । কারন আচরণবাদ রাজনীতিতে মানুষের ভূমিকার ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক

জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ


এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রথম অধ্যায়

১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)


৪) রাজনীতি চর্চায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। ১০ (২০২২)


৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)


৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।


৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)


৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)


১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।


২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। একত্ববাদী তত্ত্বের মূখ্য প্রবক্তা কারা? ১০ (২০১৯), ১০ (২০২২)


৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)

তৃতীয় অধ্যায়

১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।


২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)


৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

চতুর্থ অধ্যায়

১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।


২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


৩)  নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)


৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)

পঞ্চম অধ্যায়

১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)


২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)


৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)


৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)


৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)


৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)

যে প্রশ্নের উত্তর দরকার 

সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।

উত্তর পেয়ে যাবে-

Main Menu


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code