ভূমিকাঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব দ্বয় যে-দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত সেগুলি হল
রাজনীতি ও তত্ত্ব। রাজনীতি বলতে বোঝায় রাজনীতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ। অন্যদিকে
তত্ত্ব বলতে বোঝায় কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারনার সামান্যিকরন বা সমষ্টিবদ্ধ রুপ।
সুতরং রাজনীতিক তত্ত্ব বলতে বোঝায় সমস্থ প্রকার সামাজিক বা রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের
সামান্যিকরন বা সমষ্টিবদ্ধ রুপ। ডেভিড হেল্ড এর মতে, রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা ও সর্বজনীন
সিদ্ধান্তসমূহের এক কাঠামো। জে সি ফিল্ড এর মতে, আমরা রাজনীতির কথা বলতে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করি সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, সঙ্গতিপূর্ণ তাত্ত্বিক আলোচনাই হলো রাজনৈতিক
তত্ত্ব।
রাজনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্বঃ
i) ক্ষমতার প্রকৃতি ও উৎস বোঝাঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব ক্ষমতার উৎস ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের গভীর ধারণা প্রদান করে । ক্ষমতা কীভাবে
অর্জন,
সম্প্রসারণ, সংরক্ষণ এবং কিভাবে তা ভোগ করতে হয় তা আমরা রাজনৈতিক তত্ত্ব থেকে জানতে পারি। প্লেটো থেকে
শুরু করে ফুকো পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিক ক্ষমতার ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছেন। প্লেটোর
'দ্য রিপাবলিক' এবং ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' আমাদেরকে দেখায় কিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাস্তব জীবনে
প্রয়োগ করা হয়। শুধু তাই নয় এই তত্ত্বগুলো থেকে আমরা জানতে পারি ক্ষমতার
অপব্যবহার এর বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
ii) নৈতিক ও ন্যায়বিচারমূলক কাঠামোঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব সমাজের নৈতিক ও ন্যায়বিচারমূলক কাঠামো
গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, কীভাবে সমতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা যায় এবং কীভাবে নৈতিক
মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় তা ব্যাখ্যা
করে। জন রলসের "এ থিওরি অফ জাস্টিস" এ ধরনের নৈতিক ও ন্যায়বিচারমূলক কাঠামোর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
iii) রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কঃ
রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাও রাজনৈতিক তত্ত্বের
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। হবসের 'লেভিয়াথান' এবং জন লকের 'টু
ট্রিটিসেস অফ গভর্নমেন্ট' রাষ্ট্রের উদ্ভব ও
সমাজের ওপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। হবস বলেন, মানুষের প্রকৃতিগত অবস্থা বিশৃঙ্খল, তাই শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজন।
অন্যদিকে লক বিশ্বাস করেন, মানুষের মৌলিক
অধিকার রক্ষার জন্য সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রাষ্ট্রই যথেষ্ট। এই তত্ত্বগুলো
আমাদেরকে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্ব বোঝায়।
iv) গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রঃ
গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ও কার্যকারিতা
বোঝা রাজনৈতিক তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজনৈতিক তত্ত্ব গণতন্ত্র ও
স্বৈরতন্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তাদের সুবিধা ও অসুবিধা এবং এ ধরনের ব্যবস্থা সমাজে কী ধরনের প্রভাব ফেলে
ইত্যাদি। রাজনৈতিক
তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এই দুই ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক, সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে জানতে পারি, যা আমাদের সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন করতে সহায়তা করে।
v) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক রাজনীতিঃ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক
তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা, এবং বৈশ্বিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। আদর্শবাদ, বাস্তববাদ, প্রভূতি তত্ত্বগুলি
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতাকে সহজ সরলভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ করে। যেমন- আদর্শবাদী
তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকার উপর জোর দেয়। অন্যদিকে
বাস্তববাদী তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শক্তি এবং স্বার্থের
উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
vi) সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত
কার্যকর। আজকের বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অসমতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং অভিবাসন সমস্যার মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব
আলোচনা করে। এ্যান্তোনিও গ্রামশি, নোয়াম চমস্কি, এবং জুডিথ বাটলারের মতো চিন্তাবিদরা সমসাময়িক রাজনৈতিক
সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজতে সাহায্য করেন।
vii) সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে
সাহায্য করে। এটি সমাজ, রাষ্ট্র, এবং ক্ষমতার বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে
উত্সাহিত করে। ফুকোর শক্তি ও জ্ঞান সম্পর্কিত তত্ত্ব কিংবা গ্রামশির হেজিমনি
তত্ত্ব সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতির বিশ্লেষণকে উৎসাহিত করে।
viii) শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশঃ
রাজনৈতিক তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শিক্ষার্থীদেরকে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বিভিন্ন
দিক ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন করে। এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে আজকের
চিন্তাবিদদের পর্যন্ত—রাজনৈতিক তত্ত্বের বিভিন্ন ধারনা ও তত্ত্ব শিক্ষার্থীদের
জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু রাজনৈতিক বিজ্ঞানেই নয়, বরং দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এবং ইতিহাসের
ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়।
মূল্যায়নঃ
পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক তত্ত্ব সমাজের বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু
একাডেমিক ক্ষেত্র নয়, বাস্তব জীবনেও
রাজনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নৈতিক ও ন্যায়বিচারমূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠা, এবং রাষ্ট্রের সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে
রাজনৈতিক তত্ত্ব অপরিহার্য।
লেখক
জগন্নাথ বর্মন
সহকারী অধ্যাপক
সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজ
এই বিষয়ের ওপর অন্যান্য নোটস
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
প্রথম অধ্যায়
১) রাজনৈতিক তত্ত্ব কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার সাবেকি বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) রাজনীতি চর্চার সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো। ৫ (২০১৯), ৫ (২০২২)
৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর । ১০ (২০২০)
৬) আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা গুলির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর ।৫ (২০২১)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
৭) সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
৮) উত্তর-আচরণবাদের উপর একটি নিবন্ধ লেখ। ৫ (২০২০)
৯)রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার উত্তর-আচরনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটি সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২১)
১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর ।
দ্বিতীয় অধ্যায়
১) সার্বভৌমিকতা কাকে বলে? এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
৩) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | ১০ (২০২০) ১০ (২০২১)
তৃতীয় অধ্যায়
১) অধিকারের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
২) স্বাধীনতার ধারণাটিকে সংক্ষেপে আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
৩) সাম্যের ধারনাটি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৫) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর। ১০ (২০২০) ১০ (২০২২)
যে প্রশ্নের উত্তর দরকার
সেই প্রশ্নের ওপর ক্লিক করো।
উত্তর পেয়ে যাবে-
চতুর্থ অধ্যায়
১) উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
২) উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৩) নয়া-উদারনীতিবাদী তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর । ৫ (২০২১)
৪) নয়া-উদারনীতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। ৫ (২০২০)
পঞ্চম অধ্যায়
১) রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর । ১০ (২০২০)
২) উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। ১০ (২০২১)
৩) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্বের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫ (২০২২)
৪) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা করো। ৫ (২০১৯)
৫) সংক্ষেপে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা করো। ৫ (২০২২)
৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে গান্ধীর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। ১০ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ